দৈত্য

রাখাল গরুর পাল নিয়ে বাড়ি ফিরছেছবি: মাসুদার রহমান

গ্রামের সবাই অবাক এমন যন্ত্র আর কোনো দিন দেখেনি। মুহূর্তের মধ্যে মাটি গর্ত করে এক জায়গায় ভরাট করে ফেলে। বড় বকের মতো ঠোঁট, সঙ্গে দুই পাটি দাঁতও আছে। তালুকদার সাহেব গ্রামের এক পাশে পুকুর কাটবেন। সে জন্য আশ্চর্যজনক এক যন্ত্র আনা হয়েছে। তালুকদার শহরে থাকেন। গ্রামে পাকা বাড়ি, ফুলের বাগান। বাড়ির উত্তর পাশে বিশাল ফলের বাগান, আছে বিভিন্ন বনজ গাছ। তাঁকে একজন শৌখিন মানুষ বলা যায়। ফসলি জমিও আছে অনেক। ধানসহ বিভিন্ন ফসল উৎপন্ন হয়। বেশি লাভের আশায় সেগুলো তিনি শহরে বিক্রির জন্য পাঠিয়ে দেন।

বাড়ির পূর্ব পাশে কয়েক বিঘা জমি কেটে পুকুর কাটবেন, মাছ চাষ করবেন। গ্রামটি শহর থেকে অনেক দূরে। মানুষের মধ্যে এখনো আধুনিকতা ও উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি। গ্রামের বেশির ভাগ মানুষ নিরক্ষর। তারা আধুনিকতাকে ভয় পায়। আধুনিকতার উন্নয়নকে ধর্ম অবমাননার শামিল মনে করে। বাপ–দাদার নিয়মনীতিকে এখনো গোঁড়ামির মতো আঁকড়ে ধরে আছে গ্রামবাসী। পরিবর্তনকে ভয় পায়, সহজে মেনে নিতে চায় না।

সবাই খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে ভিড় জটলা হয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে অদ্ভুত যন্ত্রটাকে। গ্রামের মানুষেরা এর নাম দিয়েছে দৈত্য। কল্পনার রাজ্যে দৈত্যের যেমন বড় বড় হাত, পা, চোখ, দাঁত থাকে; তেমনি এ যন্ত্রের সব আছে। যন্ত্রটার মধ্যে একজন লোক। সে ওপরে বসে দুই হাতে একটা ছোট জিনিস এদিক-সেদিক ঘোরালে যন্ত্রটা কাজ করে। নারী-পুরুষ সবার আলোচনার বিষয়বস্তু এখন এটাই। পুরুষদের হাহাকার, এ কাজ যে তাদের ছিল। রাতদিন পরিশ্রম করে পুকুর রাস্তা বাড়িঘর তৈরি করে। আজ তাদের পেটে লাথি মারতে এসেছে অদ্ভুত এই দৈত্য। দুই-তিন গ্রামে মাটির কাজ এলে বেলায়েত সরদারের ডাক পড়ে। দুই বছর আগে তালুকদারের নতুন বাড়ি ভরাট বেলায়েত সরদারের হাতে করা। ইউনিয়ন পরিষদের সব রাস্তা তার কাজ। গত বছর বোর্ড স্কুলের মাটি ভরাটের কাজ করে বেশ সুনাম করেছিল বেলায়েত সরদার। কিন্তু আজ তালুকদার সাহেব তাকে ভুলে গেল। সবাই অবাক! মন খারাপও। বেলায়েত সরদারের সহকর্মীরা সবাই উদ্বিগ্ন। বেলায়েত সরদার বলে, চল সবাই তালুকদারের সঙ্গে কথা বলে ব্যাপারটা খোলাসা করে আসি।

ইমরান তালুকদার সকাল বেলা বেলায়েত সরদারের দলবল সবাইকে দেখে আশ্চর্য হয়ে যায়। বাংলো ঘরে চেয়ারে বসে কথা বলছিল। বেলায়েত সরদার ও তার দলবল দেখে তালুকদার মনে করছে গ্রামে হয়তো কোনো ঝগড়া হয়েছে। জানতে চায় গ্রামে কোনো সমস্যা হয়েছে কি না। কয়েক দিন পর তালুকদার শহর থেকে গ্রামে ফিরেছে। বেলায়েত সরদারকে বসতে বলল।

সরদার না বসে বলে, তালুকদার সাব আমাদের পেটে লাথি মারলেন। আমরা তো সবাই না খেয়ে মারা যামু। কেমন এক যন্ত্র আনছেন গ্রামে! তালুকদার বলে, এ কেমন কথা বলছ সরদার? এখন সারা দেশে এ যন্ত্র দিয়ে কাজ করছে। এর নাম মাটিকাটা যন্ত্র, সবাই ভেকু নামে চেনে। এটা দৈত্য না। মনে কর যেখানে ১০০ জন কাজ করবে, সেখানে একজন লোক এ যন্ত্রটা চালিয়ে এক দিনে সে কাজ করে ফেলতে পারবে। এবার বুঝ কত সহজ হয়ে গেছে পৃথিবী! কত উন্নত হয়ে গেছে আমাদের দেশ!

বেলায়েত সরদার বলে, আমরা তো বেকার হয়ে যাব। ছেলেমেয়ে না খেয়ে মরে যাবে। ইমরান তালুকদার বলে, তোমরা তো দেশদুনিয়ার কোনো খবর রাখো না! দেশ এখন ডিজিটালাইজড হইছে। ঘরে বসে টাকা আনা যায়, পাঠানোও যায়। সারা দুনিয়ার খবর এক মুহূর্তের মধ্যে জানা যায়। ঘরে বসে দূরদূরান্তের ছবি দেখা যায়। কম্পিউটার, ইন্টারনেট, মোবাইল আমাদের সব কাজ সহজ করে দিয়েছে। দেশ উন্নত হয়েছে। মানুষ এখন কম সময়ে বেশি কাজ করতে পছন্দ করে। কী করবা সরদার! যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের চলতে হবে যে।
সবাই চুপ। তালুকদারের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না কেউ। বাড়ি থেকে সবাই বের হয়ে আসে।

বেলায়েত সরদারের দলে আবু হোসেন নামের এক যুবক আছে। বয়সে সবার ছোট। আধুনিক ধ্যানধারণা সম্পর্কে সে জ্ঞান রাখে। বিশ্বের সব খবরাখবর রাখে। রাজনীতি থেকে শুরু করে ফুটবল, ক্রিকেট সম্বন্ধে অনেক কিছু তার নখদর্পণে। মাঝপথে সরদারকে থামতে বলে আবু হোসেন। বলে, সরদার ভাই চলেন আমরা বড় আমগাছটার নিচে বসি। কাশেম বলে, এখানে নিয়ে এলে কেন আবু হোসেন? সে বলে, সবাই বসেন। আমার একটা কথা আছে। সবাই বসে আমগাছের নিচে। মনের মধ্যে অস্থিরতা ভাব, কী বলবে সে। সবাই আবু হোসেনের মুখের দিকে তাকিয়ে। আবু হোসেন বলে, বেলায়েত ভাই, কাশেম ভাই, আমরা সবাই গাছটার নিচে বসে লেখাপড়া করেছি। পেনসিলে দাগ কেটেছি। তোমাগো মনে আছে কি? তখন গ্রামে কোনো স্কুল ছিল না। মসজিদ ছিল না। ছয় মাইল দূরে মল্লিক পাড়ায় একটি স্কুল ছিল। আবার ছয়-সাত মাস যেতে পারতাম না বর্ষার কারণে। একদিন আলম কাকা নিজ উদ্যোগে আমাগো সবাইকে ডেকে এই গাছটার নিচে বই শ্লেট নিয়ে পড়াতে শুরু করেন। আমগাছটার নিচে পড়ে শহিদ ভাই এখন শহরের বড় অফিসার। খেয়ে না খেয়ে কষ্ট করে পড়ালেখা শিখে বড় অফিসার হয়েছে। আমরা ঠিকমতো লেখাপড়া শিখি নাই, তাই আজ আমাদের এ অবস্থা। শহিদ ভাই গ্রামে এলে আমাদের খবর নেয়, সাধ্যমতো সাহায্য করে। কিন্তু আমাদের তাকে দেখে লজ্জা লাগে। শহিদ ভাই সব বুঝেন বলে, তোরা শোন, আমি যত বড় অফিসার হই না কেন, তোরা তো আপনজন, ভাই তোদের দেখা আমার দায়িত্ব। তখন সবার মন আনন্দে ভরে যায়। আর আলম কাকা মুক্তিযুদ্ধে গিয়ে শহীদ হলেন। তার জন্য আমরা কিছুই করতে পারলাম না। শহিদ ভাই কথা দিয়ে গেছে গাছটার নিচে একটা স্মৃতি সংসদ করবেন আলম কাকার নামে।

আবু হোসেন বলে, আমি এ কথা বলার জন্য তোমাদের বসাইনি। অন্য একটা কারণ আছে। সবাই মন দিয়ে শোনেন। এখন আমাদের গ্রামে স্কুল হইছে। কত সুন্দর দুইটি দালান। সুন্দর একটা ওয়াশ ব্লক হইছে। খেলার মাঠ হইছে। স্কুলে বিভিন্ন ধরনের গাছ লাগাইছে স্যাররা। স্কুল ভবনগুলো কত সুন্দর রং করা হয়েছে। দেখতে প্রজাপতির মতো লাগে। অথচ আমাদের ছেলেমেয়েরা ঠিকমতো স্কুলে যায় না। নিজেরাও কোনো খবর রাখি না ছেলেমেয়েরা স্কুলে গেল কি না। রাতে পড়তে বসল কি না, তা–ও জানি না। ছেলেমেয়েরা একদিন স্কুলে না গেলে স্যারেরা খবর নিতে বাড়ি পর্যন্ত চলে আসেন। মোবাইল করে পড়ালেখার খোঁজখবর নেন। এ জন্য আমরা তাঁদের প্রতি বিরক্ত হই। ভাইবা দেখছ তাঁরা আমাদের কত বড় উপকার করছেন। এ স্কুলে একদিন শহিদ ভাই এসে সবার ছেলেমেয়ে যেন নিয়মিত স্কুলে আসে, সে কথা সবাইকে বলেছেন।

আমার তোমাগো এখানে ডাকার কারণ হলো আমরা আজ থেকে প্রত্যেকের ছেলেমেয়েকে নিয়মিত স্কুলে পাঠাব। ওদের শিক্ষিত করে তুলতে হবে। ভবিষ্যতের জন্য তৈরি করতে হবে। আমাদের দিন গেলেও ওদের জীবনে কিন্তু বিরাট প্রতিযোগিতার হবে। ওরা বড় হতে হতে আমাদের দেশে কম্পিউটার, নেট ছাড়া কোনো কাজ চলবে না। তখন ওদের অবস্থা কী হবে ভেবে দেখেছেন সবাই? আমরা জেনেশুনে ওদের অন্ধকার জগতে ঠেলে দিতে পারি না। আজ চোখের সামনে তালুকদার সে কথা বলে দিল।
আবু হোসেনের কথায় যেন সবার চোখ খুলে যায়। চোখের মধ্যে নতুন রঙিন স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। সবার ভেতরে ঘুমিয়ে থাকা মানুষটা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। প্রতিজ্ঞা করে, আমরা আমাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ নষ্ট করে দিতে পারি না। আমাদের যত কষ্ট হয়, আমাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠাব। আনন্দে সবার চোখ ছলছল করে ওঠে।