তখন আমি চকবাজারে ব্যাচেলর হিসেবে থাকতাম। দোতলা বাড়ি। খুব কষ্ট করে ম্যানেজ করেছিলাম বাসাটা। সঙ্গে দুজন বন্ধু থাকত আমার। বাসায় দুটো বারান্দা ছিল। একটা পূর্ব দিকে, অন্যটা দক্ষিণ দিকে মুখ করা। দুটো বারান্দাতেই আমার বিচরণ ছিল, তবে দক্ষিণেরটায় একটু বেশিই সময় কাটাতাম। রোজ নিয়ম করে বিকেল পাঁচটায় চারপায়ার ওপর বসতাম। প্রথম প্রথম বই নিয়েই সময় কাটাতাম। তবে তার পরিধি বেশি ছিল না, এই বড়জোর এক-দেড় ঘণ্টা। রবি ঠাকুরের শেষের কবিতা পড়েছিলাম এই বারান্দায় বসেই। রোমিও-জুলিয়েটও এখানেই পড়েছিলাম।
এক বিকেলে আর্টপেপার নিয়ে বসে আছি, ওই বারান্দাতেই। কিন্তু কিছুতেই কিছু আঁকতে পারছিলাম না। তখনই কিছু দূরের এক বিল্ডিংয়ের বারান্দায় চোখ পড়ল। সালোয়ার–কামিজ পরা একটি মেয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। ভাবলাম, এই তো পেয়ে গেছি আঁকার বিষয়। আর দেরি না করে, আঁকা শুরু করে দিলাম। মেয়েটা আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল। সন্ধ্যা নামছিল, সঙ্গে তারাও ছিল দক্ষিণ আকাশে। গেরুয়া রঙের সালোয়ারে তাকে দারুণ লাগছিল। ঘণ্টাখানেক পর সে ভেতরে চলে গেল। অবশ্য আমার আঁকাও প্রায় শেষ। ফিনিশিং দিতে যাবো এমন সময় এক বন্ধুর ফোন এল। আঁকা বাদ দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। অনেক রাতে বাসায় ফিরলাম, সেই ছবির কথা আর মনে ছিল না। অপূর্ণ ছবিটা বারান্দাতেই রয়ে গেল।
সকালে তাড়াতাড়ি করে বেরিয়ে পড়লাম। সন্ধ্যা নাগাদ বাসায় এলাম। খুব ক্লান্ত লাগছিল। খানিক বিশ্রাম নিয়ে বারান্দায় গেলাম। হঠাৎ মনে পড়ল, ছবিটা কাল সন্ধ্যা থেকে বারান্দাতেই আছে, বাসায় ঢোকানো হয়নি। কিন্তু অবাক হলাম, বারান্দায় ছবিটা না পেয়ে। ভাবলাম, কোনো এক বন্ধু হয়তোবা তা বাসায় ঢুকিয়ে রেখেছে। বাসায় তন্ন তন্ন করে খুঁজলাম, কিন্তু পেলাম না। রাতে সবাই বাসায় এলে জিজ্ঞাসা করলাম। কিন্তু সবাই জানাল, ছবি সম্পর্কে কেউ কিছু জানে না। আমি সত্যি অবাক হলাম। ছবিটা আসলে গেল কোথায়! দুদিন পর আবার আর্টপেপার নিয়ে বারান্দায় বসে আছি, আঁকার কোনো টপিক পাচ্ছি না। তখন চোখ গেল সেই বিল্ডিংয়ে। সেই মেয়েটি আজও বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে, সেই একই গেরুয়া রঙের সালোয়ার–কামিজে।
আমি আবারও তাকে আঁকতে শুরু করলাম। চাঁদের আলোয় তার মুখটা খুবই উজ্জ্বল দেখাচ্ছিল। কী মায়াবী তার চোখ দুটো। ছবি শেষ হওয়ার আগেই সে ভেতরে চলে গেল। ছবির ফিনিশিং দিচ্ছি এমন সময় কলবেলের আওয়াজ। কিছু পুরাতন বন্ধুবান্ধবের আগমন। ছবি বারান্দায়ই রয়ে গেল। আমি তাদের সঙ্গে আড্ডায় মেতে গেলাম। ছবির কথা আর মনে নেই। সকালে কাজে বেরিয়ে গেলাম। সন্ধ্যা নাগাদ বাসায় ফিরলাম। বারান্দায় গিয়ে দেখি ছবি গায়েব। সারা বাসায় খুঁজলাম, পেলাম না। কী হচ্ছে এসব, দু-দুটো ছবি গায়েব! রাতে আর ঘুমাতে পারলাম না। এরপর বেশ কয়েক দিন আর বারান্দায় যাওয়া হয়নি।
একদিন সন্ধ্যা নাগাদ বাসায় ফিরছিলাম, সেই বিল্ডিংয়ে চোখ গেল। ভাবলাম একটু ঘুরে আসি। দেখে মনে হলো বেশ পুরোনো বিল্ডিং, মেইন গেটে তালা ঝোলানো। অনেক দিন বোধ হয় খোলা হয়নি। একটু শঙ্কা হলো। পাশের দোকানদার থেকে জানলাম বছর কুড়ি হচ্ছে বিল্ডিংটা তালাবন্ধ। কোনো এক মেয়ে আত্মহত্যা করেছিল, ছাদ থেকে লাফ দিয়ে। তার পরনে গেরুয়া রঙের সালোয়ার ছিল। আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারিনি। তাড়াতাড়ি বাসায় চলে এলাম। মাথাটা কেন জানি ঘোরাতে লাগল। খেয়েদেয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লাম।
সকালে উঠেও একই কথা ভাবতে লাগলাম। আধুনিকতার এ যুগেও কি এ রকম হতে পারে? আমার আঁকা ছবি দুটিই–বা কোথায়? এটা আমার হ্যালুসিলেশন নাকি বাস্তব? কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি। তারপর হঠাৎ একদিন মনে হলো বারান্দায় যাই। সময়টা সন্ধ্যা নাগাদ। বারান্দায় গিয়েই আমি অবাক। সেই দুটো ছবি চারপায়ার ওপর রাখা। আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। ছবিগুলো অসম্পূর্ণ ছিল, কিন্তু এগুলো তো সম্পূর্ণ! বলা যায়, আগের থেকেও বহুগুণ সুন্দর ও জীবন্ত।