দক্ষিণের জানালা

প্রতীকী ছবি।
অলংকরণ: বাবুল হোসাইন সোহাগ

আমাদের গলির প্রবেশমুখে রণজিৎ দারোগার তিনতলা বাড়িটা দারোগার মতোই পাওয়ার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দেমাগে মহল্লার প্রত্যেককেই যেন ধমকায়। বেশি ধমকায় তার কোল ঘেঁষে লিলিপুটের মতো দাঁড়িয়ে থাকা আমাদের একতলা বাড়িটাকে। সামন্ত জমিদারের প্রজার মতো ভয়ে জড়সড় থাকে। কিসে বেয়াদবি হয়। খুব সম্ভবত, আমার লাইফে তো নয়ই, আমার বাবার লাইফেও জোরেশোরে চিল্লানোর রেকর্ড নেই। ছোট বোন মিলি ডেঞ্জারস টাইপের পুরুষালি স্বভাবের মেয়ে। সবকিছুতেই নো কেয়ার ভাব। বেশ বেয়াড়াও। ক্রিকেট খেলায় খুব নেশা। বল-ব্যাট নিয়ে ছেলেদের মতো প্র্যাকটিস করে। এই মিলিও কোনো দিন সাহস করে ছক্কা মারতে পারেনি। বাবার কঠিন চোখরাঙানি দারোগাবাড়ির চেয়েও কঠিন ছিল। বাস্তবিকই, এই বাড়ির মানুষেরা খুব অসামাজিক ছিলেন কি না, সেটাও জানার উপায় ছিল না। কেন জানি একটা সম্ভ্রম বোধ থেকেই আমরা নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে চলেছি। আমার বাবা কলেজ টিচার ছিলেন, হতে পারে দারোগার সঙ্গে অন্ধিসন্ধি ভাব তার আইডলজিতে বেমানান ভেবে ইচ্ছে করেই এই কৃত্রিম দূরত্ব। আর বাবার কারণে আমরা ভাইবোনও একপ্রকার দূরত্ব নিয়েই চলেছি। নিজের দৈন্যের বিপরীতে দারোগার বিপুল বিত্তবৈভব, তুঘলকি লাইফস্টাইল যেন সন্তানদের মনে আঁচড় কাটতে না পারে, সেদিকে বাবার নজর ছিল টনটনে। তাঁর বিশ্বাস ছিল, দারোগাবাড়ির দেমাগ-জৌলুশ সবই ঘুষের টাকায়। দারোগারা ঠিক মানুষ কি না, এই নিয়ে বরাবর কনফিউশনে থেকেছেন বাবা নিজে এবং আমাদের মধ্যেও তা চালান করে দিতেন।

অষ্টাদশ বয়সের ফেড়ে পড়ে আমার ভেতর-বাইরে তখন চরম হইচই। চঞ্চল চোখ জোড়া ফড়িঙের মতোই উড়ে বেড়াচ্ছে। এক সকালে পড়ার টেবিলে বসেই আবিষ্কার করলাম, পাশের বাড়ির এক ষোড়শীর কালো দুটি চকচকে চোখ আমার জানালার শিক ধরে নাচানাচি করছে! তার উদ্ধত স্পর্ধিত বুক জানালার লোহার শিকে সজোরে মাথা ঠুকছে। যেন বলছে, কারার এই লৌহ কবাট ভেঙে চল! ভেঙে চল! মীরাক্কেল তো! বুদ্ধিমানের জন্য ইশারাই কাফি।

ট্রাফিক সিগন্যালের মতো বাবার খবরদারি চোখকে বোকা বানিয়ে আমার চোখ প্রায়ই দারোগাবাড়ির দোতলার দক্ষিণের জানালায় যক্ষপত্নীর মতো ষোড়শী বিরহিনীর চোখের সঙ্গে কোলাকুলি করতে লাগল। ক্লিন সেভ করে, চুল পরিপাটি করে আঁচড়ে জানালা খুলে বসে যেতাম প্রমোদ ভবনের প্রমোদ বিহারে। তার ঢেউতোলা ঠোঁট এদিক-সেদিক করে, মাথা হেলিয়ে-দুলিয়ে কত কথা যে বলত; তার কিছু বুঝেছি, কিছু তরজমা করে নিয়েছি। সকালের একটুকরো সোনালি রোদ আমার হয়ে উন্মত্ত চুমোয় লালে লাল করে দিত ষোড়শীর দুই গাল। মধুকরের মধুর লোভ যখন উত্তরোত্তর বেড়ে ডেঞ্জার জোন ক্রস করে গেল, তখন আর গোপন থাকল না। হুট করে চোখে পড়ল মিলির। সেদিন বিকেলেই বাবা বললেন, ‘তোমার চোখ ওপরে চলাফেরা করে কেন?’ ঠিক এই সময় এক ঝাঁক চিল উড়ে যাচ্ছিল, সেদিকেই চোখ করে আমি বললাম, ‘আকাশের চিল গুনি, বাবা।’ বাবা বললেন, ‘চিল গুনে লাভ হবে না। শুধুই ভুল গণনা হবে।’ বাবা কী বোঝালেন এবং আমি কী বুঝলাম, এর কোনোটাই ক্লিয়ার না হলেও পরের দিনই আমার রুম ট্রান্সফার হলো—মিলিকে আমার ঘরে, আর আমাকে মিলির ঘরে।

শেখরদার সঙ্গে আমার এজ ডিফারেন্স চোখে পড়ার মতো। মিনিমাম টেন ইয়ারস তো বটেই। গুড ফ্রেন্ডশিপের জন্য এজ মেটার নয়, মনটাই মেটার। দুজনের সবকিছুতেই দারুণ শেয়ারিং। বউদির সঙ্গে টুটা-ফাটা যা ঘটে, সবই গল্পের ফাঁকে ফাঁকে চালিয়ে দেয়। একটা প্রাইভেট স্কুলে পড়ায়। বৌদিও একটা সার্ভিস করছে। ওরা আমাদের বাসার সামনের বাসার ভাড়াটিয়া। অদৃশ্য এক কারণে সে বাবার ওপর চরম চটে আছে। প্রায়ই গালাগালি করে। সেদিন বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো আমার উদ্দেশে বলছে, ‘তোর বাবা সেকেলেই আছে! মানুষটাকে একদমই সহ্য হয় না। তোর বাবা বলেই এক্সটা অনার করি। কিন্তু আমি ভাবছি অন্য কথা। তোর বাবা কি...’

আমি চমকে উঠলাম, ‘বাবা কী?’

এক মিনিটের মতো থ মেরে বসে কী যেন ভাবল। তারপর গম্ভীর কণ্ঠে চোখ টিপে টিপে বলল, ‘তুই তলে তলে এত দূর এগিয়ে গেলি! এখন ফিরবি কী করে? দারোগা শালা তো কসাইরে! তোকে ধরে দিনেদুপুরে জবাই করবে, কাবাব বানাবে।’

আমি আঁতকে উঠি, ‘কেন? আমি কী করেছি?’

শেখরদা ফ্যাক করে হেসে দিল এবার, ‘বারে, তার মেয়ের সাথে জানালাপ্রেম করবা, ছাদপ্রেম করবা, আর তিনি আইনের মানুষ হয়ে বসে মুরগি-পোলাও খাবেন, আর আঙুল চুষবেন, অ্যা!’

শেখরদার শকুনের চোখ। আমার চোখ দেখেই মনে হয় ধরে ফেলেছে। নিজেকে ডিফেন্স করে বলি, ‘আমি কি তার মেয়ের সাথে প্রেম করেছি নাকি যে আমাকে কাবাব বানাবে?’

শেখরদা মুখে চুকচুক শব্দ করে ভারিক্কি ভাব নিল। আমি আমতা-আমতা করে বললাম, ‘স্রেফ চোখে চোখ...!’

‘ওহ্! স্রেফ জানালাপ্রেম?’

‘ধ্যাত্, তুমি ফের ঘুরিয়ে-প্যাঁচিয়ে একই হিরন পয়েন্টে আসো। ভীষণ রাগ হচ্ছে তোমার ওপর। তোমার সাথে আর কথা নেই।’ আমার অস্থিরতাকে হেঁয়ালি করে শেখর দা বলে, ‘মেজাজ ঠান্ডা করে বস। তোর বৌদি চা দেবে। তুই প্রেমিক মানুষ। একটু-আধটু অস্থিরতা থাকবেই। তার ওপর তোর প্রেমিকা দারোগার মেয়ে।’

শেখরদা সামান্য বিষয় নিয়ে এতটা হেঁয়ালি করবে, আমি তা ভাবিনি।

বৌদি পেছন এসে কখন দাঁড়াল কে জানে। আমি পিঠ ফিরে তাকাতেই বলে, ‘চা নাও।’ আমি বললাম, ‘দাও, এখানেই দুচুমুক দিয়ে যাই। দাদা সবকিছুতেই এক কাঠি বেশি বোঝে। বেশি বকে।’ বৌদি কেমন আননোন একটি হাসি দিল। ‘এত অস্থির কেন?’ বৌদি আবার দাদার চেয়েও এক কাঠি বেশি বুঝে অর্থাৎ দুই কাঠি বেশি। বলে কিনা, ‘দারোগার মেয়ে ছন্দোবতীর প্রেমে পড়েছ?’

‘বৌদি, তুমিও দাদার মতো! তোমাদের দুজনেরই হেডকোয়ার্টারে গন্ডগোল আছে। ডাক্তার দেখাও।’ বলেই চলে আসছি। পেছন থেকে কানে বাজছে, বৌদি হু হু হাসছে আর বলছে, ‘গুরু-শিষ্যকে একই রোগ ধরেছে দেখছি।’

হার্ট-ফেইলর রোগীর মতো আমার নিশ্বাস আটকে গেল। আমি থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম। বৌদি বলে কী! গুরু-শিষ্যকে একই রোগ ধরেছে মানে কী? ধ্যাত! বৌদি মানুষটা কোনো দিনই সিরিয়াস হলো না। শেষ পর্যন্ত এই বিষয়টাকে হেঁয়ালির হিসেবে নিল। অথচ কত সিরিয়াস বিষয়। জানালায় বসে যখন দেখবে, আমার পড়ার টেবিলে মিলি বসে আছে, কী ভাববে তখন সে? আমার পজিশন জিরোতে নেমে এল না? ইশ্‌, শালার বাবাটাও যে কী ধাতু দিয়ে তৈরি? হিটলারের মামাতো ভাই। আছে ফালতু সব ভ্যালুজ নিয়ে। বাড়িতে এসে অভ্যাসমতো সেই রুমে যেতেই বাবার ধমক কানে এল, ‘ও ঘরে কেন যাচ্ছ?’

আমি মাথা চুলকাতে চুলকাতে বললাম, ‘দুইটা বই থেকে গেছে।’

‘মিলি দিয়ে আসবে। তুমি তোমার রুমে যাও।’

বারবার চোখ ইশারার পরও গর্দভ মিলিটা বাবাকে বলল, ‘না বাবা, দাদার তো কোনো বই চোখে পড়ল না।’ মাকে ডাকলেন বাবা। কিচেন থেকে মা এলেন আঁচলে ঘাম মুছতে মুছতে, ‘চটজলদি বলো। চুলায় মাছ ভাজা বসিয়ে এসেছি।’ বাবা বললেন, ‘রাখো তো তোমার মাছ ভাজা, ছেলে যে আমাদের চিতায় তুলে ভেজে খেয়ে ফেলার ব্যবস্থা করে ফেলছে, সেই খবর রেখেছ?’ মা ভ্রু কুঁচকায়। ‘হেঁয়ালি রেখে ক্লিয়ার করে বলো।’ এরই মধ্যে মা মিলিকে বলল, ‘যা তো মিলি, চুলাটা কমিয়ে দিয়ে আয়।’

‘তোমার ছেলে তো সামনেই, জিজ্ঞেস করো।’

নিজেকে কেন যে হাস্যকর দুর্বিপাকের মধ্যে ঠেলে ফেললাম! ভীষণ বেকায়দায় পড়েছি কায়দামাফিক। নিরাপদ দূরত্বের প্রমোদ বিহারের অপরাধে এমন গোয়েন্দা নজরদারি ও রেড অ্যালার্ট জারি কিছুটা বাড়াবাড়ি ঠেকল। কিন্তু বাবাকে জ্ঞান দেবে কার সাধ্য? মা বরং বাবাকে সাপোর্ট করে বলল, ‘এত সকাল সকালই চিতায় তুলবি বাবা! আরও কিছুদিন বাঁচার সাধ ছিল যে।’ খানিকটা ইমব্যালেন্স হয়ে বলে বসলাম, ‘ফাও কথার জবাব দেওয়ার টাইম নেই আমার।’ মা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল। বাবা ফুঁসে উঠল।

এরপর আর খবর নেওয়া হয়নি। জানালা আগের মতো খোলা থাকে কি না, জানি না। মিলিকে জিজ্ঞেস করব, সেই সাহসও নেই। ও বাবার এক নম্বর স্পাই। ফাইনাল পরীক্ষার ডেট ফিক্সড হয়ে গেল। এ-প্লাস ছুটে যাওয়ার তীব্র আশঙ্কা দেখা দিল। যা পড়েছিলাম, সবই উধাও হয়ে গেছে এই কদিনে। ডাক্তার হওয়ার লম্বা এক স্বপ্ন সামনে। অন্ধকার নেমে আসে চোখে। সেই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বাসা ছেড়ে কলেজের হোস্টেলে উঠলাম। টানা তিন মাস গৃহবন্দিত্ব চলল।

শেখরদার সাথে সেই যে আড়ি করে চলে এলাম, আর যাওয়া হয়নি। মিলি শেখরদার স্কুলেই পড়ে। ওকে দিয়ে বার কয়েক খবর পাঠালে, সে প্রথম খবরটি জানাত মাকে। মা খবরটিকে সেখানেই গলা টিপে মেরে কবর দিত। আমার অব্দি পৌঁছাতে দেয়নি। শেখরদা আমাদের বাড়িতে আসে না। বাবাকে সে দেখতে পারে না, বাবার চোখের বিষ সে। পরীক্ষার সব ঝুটঝামেলা শেষে সেই দিন বিকেলেই বাড়িতে ফিরে ফুরফুরে মেজাজে শেখরদার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। বাড়ির প্রবেশমুখে বৌদি দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখেই উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল, ‘কী প্রেমিক মশায়! প্রেমিকার বিয়ে হচ্ছে, আপনি আত্মগোপন করেছিলেন কোথায়?’

‘তার মানে? কার বিয়ে?’

বৌদি চোখ নাচিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করে, ‘কেন? তুমি জানো না। তোমাদের ছন্দোবতীর কাল বিয়ে?’

কড়াৎ করে আমার ভেতরের বন্ধ জানালা ওপেন হয়ে গেল। নিঃশব্দ, নীরব, মায়াটানা দুটি চোখ জানালার শিকের ফাঁকে ফাঁকে দেখা যাচ্ছে। কে সে? তাকে কি আমি চিনি? হ্যাঁ, চিনি তো! মেয়েটির নাম ছন্দোবতী! জীবনের ছন্দ খুঁজে পাচ্ছে সে। সুখে থাকো। কিন্তু শরীরজুড়ে ভীষণ কোলাহল বেধে গেল। ফিরে যেতে ভদ্রতায় বাধল বলে, না হলে শেখরদার সাথে দেখা করতে মন টানছে না। বিষয়টা নিয়ে আজকে আর হেঁয়ালি শরীরে কুলাবে না। শেখরদার সামনে যেতেই বলল, ‘বস।’ বেশ গম্ভীর দেখাচ্ছে তাকে। ‘কোথায় লাপাত্তা হয়ে গেছিলি? মিলিকে দিয়ে কতবার খবর পাঠালাম। তোর কোনো হদিস নেই। আমার মনটা খুব উচাটন রে! তোর সঙ্গে শেয়ার করব একটা বিষয়।’

‘পাশের বাড়ির মেয়েটির নাকি কাল বিয়ে?’

শেখরদা নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল, ‘তোর বৌদি বলেছে?’

চট করে উঠে দাঁড়ালাম, লম্বা একটি শ্বাস ফেলে বললাম, ‘আমি উঠি শেখরদা। পাশের বাড়ির মেয়েটির তাহলে কাল বিয়ে হচ্ছে।’

শেখরদার চোখ দুটি উথালপাতাল কাঁপছে। আমার চেয়ে দ্বিগুণ লম্বা একটি শ্বাস ফেলে বলল, ‘কেমন অস্থির লাগছে। জানিস তো, পাশের বাড়ির মেয়েটির কাল বিয়ে। ওহ, সরি, তোর বৌদি তো বলেছে।’