তোমার পায়ের আওয়াজ

তারুণ্য একটি শক্তি
ছবি: সংগৃহীত

যুক্ত করো হে সবার সঙ্গে,

মুক্ত করো হে বন্ধ,

সঞ্চার করো সকল কর্মে

শান্ত তোমার ছন্দ।

জীবনের প্রথম লড়াইটা নিজেকে তৈরি করার, সমৃদ্ধ মানুষ হিসেবে তুলে ধরার। মানুষকে প্রথমে নিজের জন্য করতে হয়। আবার সবই নিজের জন্য করলে মানুষ হিসেবে তার পরিচয় থাকে না। অন্য প্রাণী থেকে মানুষের কিছু বাড়তি সুবিধা আছে। মানুষ পরিস্থিতি অনুধাবন করতে পারে। প্রতিকূলতাকে আয়ত্তে আনতে পারে। কিন্তু আমরা পরিস্থিতিকে বুঝতে পারছি না, আয়ত্তে আনতে পারছি না। কেবলই পিছিয়ে পড়ছি। উটপাখির একটি দর্শন আছে। তা হলো, ‘যদি আপনি বিপদ দেখতে না পান, তবে তার কোনো অস্তিত্বই নেই।’ স্বার্থপরের মতো বিপদকে অগ্রাহ্য করতে থাকেন। জীবনের চারপাশে সংকট। উত্তরণের জন্য চাই দৃঢ় প্রত্যয়। প্রত্যয়ী মানুষ কখনো পেছনে ফেরে না। বিড়াল ও ইঁদুরের সেই গল্পটি, ছোট্ট ইঁদুর পরামর্শককে প্রশ্ন করল, ‘বিড়ালের গলায় ঘণ্টা ঝোলাবে কে?’ আমার কাজ পরামর্শ দেওয়া। কে ঘণ্টা বাঁধবে এটা ভাববে তোমরা। ছোট ইঁদুরটি গভীরভাবে ভাবল। বিড়ালের জন্য ঘুমের ওষুধ কিনল। ঘণ্টা বাঁধল। কেউ যদি দূরদর্শী হয়, আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়, সমাধান আছে এমন বিশ্বাস নিয়ে এগোয়, তা হলে সে কাজটি পারবেই। এখানেই তরুণেরা ব্যতিক্রম। তারা কোনো কিছুতে হার মানে না। তরুণদের সৃজনশক্তি ও সাহস অন্যদের রক্ষা করতে পারে। বর্তমানই শ্রেষ্ঠ, এটিই তাদের দর্শন। দেশের নাগরিকের শতভাগ তরুণ নয়। কিন্তু ভবিষ্যতের শতভাগ নির্মাণ করে তরুণেরা।

শুভ ও অশুভের একটা জগত্ আছে। এরা পরস্পরবিরেধী। যেখানে শুভ, সেখানেই অশুভ। এ দুইয়ের মধ্যে আছে বাস্তবতা। সে সবকিছুকে নিয়ন্ত্রণ করে। মানুষ ছাড়া অন্য কারও কোনো ক্ষমতা নেই। মানুষ নিজেই তার ভাগ্যের নিয়ন্তা। আবার দুর্ভাগ্যেরও কারণ। সে নিজেই ভালো-মন্দ সৃষ্টি করে। দুটি হাত চোখের ওপর রেখে বলে অন্ধকার। ঘন অন্ধকারে ছেয়ে যায় চারপাশ। হাত সরালেই দেখতে পায় আলো। তখন নিজেকে উজ্জীবিত মনে হয়। জীবনে সংকট তীব্র। কোনো ঝুঁকি ছাড়া কোনো অর্জন হয় না। ইতিহাসের পাতা সভ্যতার তথ্যে পূর্ণ। যে আচরণ পুরস্কৃত হয়, তা বারবার ফিরে আসে। ব্যক্তিজীবনে এর হিসাব জীবনে আছে।

তারুণ্য উন্নয়ন, গতি, শক্তি ও সমৃদ্ধির প্রতীক। তারা এই জীর্ণ ক্যানভাসে এঁকে দেবে আলোর রেখা।

সমাজের ভিত্তি হলো পারস্পরিক সহযোগিতা, দায়িত্ব, অনুধাবন, নিয়মকানুন ইত্যাদি। এসব উপাদান ছাড়া সমাজ বিমূর্ত। এ উপাদান আমাদের মানবিক জায়গায় দাঁড় করায়। বস্তুগত দরিদ্রতার প্রতিকার আছে। কিন্তু আত্মার দরিদ্রতার মুক্তি নেই।

একটি দেশ মায়ের মতো। তাকে শ্রদ্ধা করতে হয়। ভালোবাসতে হয়। সে মায়ের ভেতরগত এত বিচ্ছিন্নতা ও দুর্বলতা নিয়ে কেউ সামনে এগোতে পারে না।

সময়ের প্রয়োজনে কাউকে না কাউকে এগিয়ে আসতে হয়। সেই কেউ হবে আমাদের তরুণেরা। তারুণ্যই হবে পরিবর্তনের প্রতিচ্ছবি।

মানুষ কখনো কখনো সত্যিকার অপরাধবোধ থেকে ক্ষমা প্রার্থনা করে। তখন সে ক্ষমায় মানবিকতা ও সহানুভূতি প্রকাশ পায়। আবার কখনো নেমে যায় পশুর স্তরে। তখন মানুষ পশুর মতো আচরণ করে না। এর চেয়ে খারাপ আচরণ করে। আমাদের নৈতিকতা অনেক নিচে নেমে গেছে। তাই অন্যায় করার জন্য কোনো সাহসের প্রয়োজন হয় না, বরং ভালো কিছু করার সাহসের প্রয়োজন হয়। অনেকে বলেন, আমি অন্যায়কে প্রশ্রয় দিই না। নিরপেক্ষ মানুষ। এখানেও স্ববিরোধিতা আছে। অন্যায়ের বিরোধিতা না করলে তাকে উত্সাহিত করা হয়। আমরা সমাধানের অংশ না হলে আমরা নিজেরাই সমস্যা।

ডারউইন তত্ত্বের পরিহাসটি হলো, ‘সে-ই যোগ্যতম, যে শঠতায় শ্রেষ্ঠ খুনি, ধর্ষক, চাঁদাবাজ।’ এ পরিহাস থেকে মুক্তির পথ খুঁজতে হবে। কেবল তারুণ্যই পারে এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে। তারুণ্য একটি শক্তি। এ শক্তিকে অবদমিত করা যায় না, নষ্ট করা যায় না, থামিয়ে দেওয়া যায় না। সমাজের অসংগতির বিরুদ্ধে সে একাই দাঁড়িয়ে যায়। তাই নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে তরুণদের হতে হয় সবার।

প্রত্যেক প্রজন্মেরই কিছু ভালো মানুষ থাকে, যাঁরা সবাইকে জড়ো করে নতুন একটি পতাকার নিচে। চেষ্টা না করার চেয়ে ঝুঁকি নিয়ে হেরে যাওয়া ভালো। যুক্তরাষ্ট্রের প্যাট্রিক হেনরির একটি ঐতিহাসিক ভাষণ, ‘আমরা যদি স্বাধীন হতে চাই, আমাদের লড়তে হবে। দ্বিধা ও নিষ্ক্রিয়তার মাধ্যমে কোনো শক্তি অর্জন করা যায় না। জীবন কি এতই প্রিয় যে দাসত্বের বিনিময়ে তা ক্রয় করতে হবে? অন্যরা কী করবে আমার জানা নেই। আমি স্বাধীনতা চাই। নাহয় মৃত্যু।’ যাঁরা নীতির ঊর্ধ্বে সুবিধাকে স্থান দেন, তাঁরা দুটোকেই হারান। তরুণদের চরিত্রে থাকে সততা ও দৃঢ়তা। তারা সবাইকে একত্রিত করে, নেতৃত্ব দেয়। কর্তব্যের ডাকে পৃথিবীর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যায়। তারা শিষ্য তৈরি করে না, নেতা তৈরি করে।

জেলিফিশ মাঝেমধ্যে শামুক গিলে নেয়। কিন্তু শামুকও বেঁচে থাকার চেষ্টা করে। শামুক খোলস থেকে মুখ বের করে জেলিফিশকেই খেতে থাকে। দেশে দেশে কিছু শামুকের জন্ম হয়। এরা দেশকেই ধ্বংস করে। মিসরসহ অনেক দেশের তরুণেরা এদের হটিয়েছে। আমাদের দেশের তরুণেরাও বারবার জেগে উঠেছে অপশক্তির বিরুদ্ধে। তারা সফলও হয়েছে। কোনো কালে কোনো দেশে অমঙ্গলকর প্রজাতি টিকে থাকেনি। ধ্বংস তাদের অনিবার্য। সব সময়ই আমরা অতীতের পুনরাবৃত্তি ঘটাই। বারবার মাশুল দিই। সমাজকে জোরে ঝাঁকুনি দেওয়ার জন্য তরুণদের বিকল্প নেই। অফুরন্ত মানবিক শক্তি নিয়ে শত্রুকে পরাজিত করে তারুণ্য।

স্যামুয়েল জনসন বলেছেন, ‘দেশপ্রেম দুষ্টু লোকের শেষ অবলম্বন।’ উক্তিটি মিথ্যা আবার সত্য। কিছু অসত্ মানুষ সুযোগ বুঝে দেশপ্রেমিক হয়। অন্যদিকে এ উক্তি সত্য বলে—বঙ্গবন্ধু, জর্জ ওয়াশিংটন, উইনস্টন চার্চিল, আব্রাহাম লিংকন, মহাত্মা গান্ধী—এঁদের দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন ওঠে না। দেশপ্রেমের একটা চিরন্তনতা আছে। নাথাল হেল বলেছেন, ‘আমার দুঃখ যে দেশকে দেওয়ার জন্য মাত্র একটি জীবন রয়েছে।’ আমাদের এই ‘জাতীয়’ বোধটার বড় অভাব। জীবনের প্রতিটি কাজে জাতীয় বোধ থাকবে সামনে। বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন ধরনের খেলা হয়। কেউ দেশের জয়ের জন্য খেলে। কেউ চুক্তি বাতিলের ভয়ে খেলে। একদল জাতীয় গর্বে জীবন বাজি রাখে, অন্যদল হেরে না যাওয়ার জন্য বেপরোয়া হয়। দুটি দলই খেলে। এই খেলার মধ্যে রয়েছে আদর্শগত পার্থক্য। নিজের দেশকে ভালোবাসা মানে অন্যকে ছোট করা নয়। নিজের শ্রেষ্ঠত্বকে প্রমাণের জন্য অন্যকে হেয় করার অধিকার কারও নেই। কিছু মানুষ নিজের স্বার্থ ছাড়া সবকিছুকে অগ্রাহ্য করে। কিছু আছে দুর্বল ভীরু দেশপ্রেমিক। সুবিধা কিংবা অসুবিধা কোনোটিই তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য নয়। কোনো বিপদের প্রথম ধাপেই হেরে যায়।

পরিবর্তন আনার একমাত্র উপায় হলো নৈতিকতার সঙ্গে আপস না করা। সত্ আচরণ করা। জনরাসকিন বলেছেন, ‘শিশুকে সততার ধারক হতে শেখানো হলো প্রথম পাঠ। জর্জ বার্নাড শ এক অতি ভদ্র মহিলাকে এক হাজার, দশ হাজার শেষে এক লাখ পাউন্ডের বিনিময়ে তাঁর রাতের সঙ্গী হতে বললেন। প্রথম ও দ্বিতীয় প্রস্তাবে রেগে গিয়েছিলেন। তৃতীয়বার বললেন সম্ভব হতে পারে। শ বললেন, এক হাজার পাউন্ডে রাজি হলেন না কেন? আপনি আমাকে কী মনে করেন? আমাকে অপমান করছেন। আপনি কী, সেটা আমি বুঝেছি। এখন কেবল দর-কষাকষি করছি। সততার ভিত্তি শক্ত না হলে একসময় সবকিছু ভেঙে পড়ে। একটি জাতির জন্য কেবল কিছু রাস্তাঘাট, উড়ালসড়ক, উঁচু ভবন নির্মাণই শেষ কথা নয়। জীবনযাপনের নৈতিক একটি পরিবেশ তৈরি খুব প্রয়োজন। জাতির সামনে অনেকগুলো প্রশ্ন রয়েছে। এতসব প্রশ্ন অমীমাংসিত রেখে একটি দেশ সমানে এগোতে পারে না। সতর্কতা ও চেতনার অভাবেই পাঠান, তুর্কি, মোগল, ইংরেজ শত শত বছর আমাদের শাসন করেছে। যে সমাজ কেবল সুবিধার জন্য নীতি বিসর্জন দেয়, সে সমাজ সুবিধা ও নীতি দুটোই হারায়। জীবন হলো ভালোবাসা ও বিশ্বাসের চুক্তি।

তরুণেরা জন্মভূমির জন্য জীবন বিপন্ন করে। আমরা ইলা মিত্র, প্রীতিলতা, ক্ষুদিরাম, সূর্য সেন, ষাটের দশকের আসাদ আর আশির দশকের শেষের দিকে নূর হোসেনদের কথা জানি। তাঁরা প্রত্যেকে অন্যের বেঁচে থাকার অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিজেদের জীবন উত্সর্গ করেছিলেন। ভালোবাসার প্রমাণ দিয়েছিলেন জীবন দিয়ে। ষাটের দশকে লেখা হেলাল হাফিজের একটি অমর, অনবদ্য কবিতার পঙিক্তর কথা মনে পড়ছে, ‘এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’। ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান থেকে আজ অবধি সভা-সমাবেশ, মিটিং-মিছিল ও দেয়াললিখনে কবিতার এ পঙিক্তযুগল ব্যাপক ব্যবহূত হয়ে আসছে। তাঁর ভাবনায় তরুণদের এখন বাঁধভাঙা যৌবন। তারা সবকিছু করার ক্ষমতা রাখে। তারা সামনে থেকে নেতৃত্ব দেয়। অশুভ বিপ্লবের বিরুদ্ধে প্রতিবিপ্লব করে।

আমরা একে অপরের সহযোগিতায় এগিয়ে যাই। প্রতিযোগিতায় নয়। মানবমর্যাদার পক্ষে দাঁড়ালে অত্যাচারী ও বিবেকহীন লোকের মুখোমুখি হতে হয়। তাদের শাস্তি দিতে হয়, বিচারের মুখে আনতে হয়। তা না হলে সত্ নাগরিকের নৈতিক শক্তি ভেঙে পড়ে। অনেক সত্ মানুষ এসব ক্ষমা করে না। সহ্য করে। এটা একধরনের পরাজয়ী মনোভাব। আমাদের নীরবতার জন্যই অন্যায়, অত্যাচার, অপরাধ চক্রাকারে অন্তহীন চলছেই। তরুণেরা সমাজ বদলে দিতে পারে, এটা ঐতিহাসিক সত্য। তারুণ্য আদর্শ, শক্তি, শান্তি ও ভালোবাসার প্রতীক। তারুণ্যের বিপুল শক্তি নিয়ে জেগে ওঠার অপেক্ষায় বাংলাদেশ।