তৃপ্তাশ্রু

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

বেশ কয়েক দিন ধরে বাবার শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। অনেক ডাক্তার দেখিয়েছেন, পুরো শরীর চেকআপ করিয়েছেন, সব ওকে, ডায়াবেটিস একটু আছে, তা–ও কন্ট্রোলের মধ্যে। জটিল কোনো সমস্যা নেই, তারপরও সেরে উঠছেন না। কয়েক দিন ভালো থাকেন তো আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন। বাবাকে নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন মতিন সাহেব।

মতিন সাহেবের বাবা আনোয়ারুল হক, সবাই তাঁকে হক স্যার নামে চেনেন। শিক্ষকতা করতেন। ৩৫ বছরের শিক্ষকতাজীবনে ২৪ বছর ছিলেন নিজ গ্রামের সফিপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তিনি যখন নিজ গ্রামের স্কুলে এসে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন, তখন পনেরো-বিশজন পরীক্ষার্থী এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিত। ধীরে ধীরে আনোয়ারুল হকের নিরলস প্রচেষ্টায় এখন প্রায় দেড় শ ছাত্রছাত্রী পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে। প্রথমদিকে তিনি বাড়ি বাড়ি ঘুরে, অভিভাবকদের নিয়ে বৈঠক করে, গরিব মানুষের মধ্যে শিক্ষার গুরুত্ব বুঝিয়ে, অভাবী ছাত্রছাত্রীদের আর্থিক সাহায্য দিয়ে, বই–খাতা দিয়ে, টিউশন ফি মওকুফ করাসহ বিভিন্নভাবে চেষ্টা করে স্কুলকে এ অবস্থায় নিয়ে এসেছেন। একজন সৎ, সজ্জন, বিদ্যানুরাগী, পরোপকারী ও অত্যন্ত সাদামনের মানুষ। সবাই তাঁকে শ্রদ্ধার চোখে দেখেন।

আনোয়ারুল হক অবসর নিয়েছেন সেই সাত বছর আগে। গ্রামের বাড়িতেই ছিলেন স্ত্রীকে নিয়ে। বছর দুই আগে স্ত্রী মারা যাওয়ায় আনোয়ারুল হক একা হয়ে যান। তখন মতিন সাহেব অনেক বুঝিয়ে নিজের ফ্ল্যাটে নিয়ে আসেন বাবাকে। জিনিয়া প্রথম প্রথম একটু ঘ্যান ঘ্যান করেছ। কিন্তু বাবা নীতিমান শিক্ষক মানুষ। নাতিদের লেখাপড়ায় মনোযোগী করা, খেলাধুলায় সময় দেওয়া, বিকেলে হাঁটতে নিয়ে যাওয়া, নানা বিষয়ে বাবার দায়িত্ববোধ দেখে জিনিয়ারও তাঁর প্রতি একটু মমত্ববোধ গড়ে ওঠে।

মতিন সাহেব একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের জেনারেল ম্যানেজার। কলিগ নেয়ামত উল্লাহ জানান, ধানমন্ডিতে এক ডাক্তার বসেন, নাম মুহিত। কয়েকটি প্রাইভেট হসপিটালের ভিজিটিং কনসালট্যান্ট। বিদেশে ছিলেন দীর্ঘদিন। বছরখানেক হলো দেশে এসেছেন। এর মধ্যেই বেশ সুনাম কুড়িয়েছেন। মতিন সাহেব চার দিনের মাথায় সিরিয়াল পেলেন। বাবাকে নিয়ে নিজেই গেলেন। ঘণ্টাখানেক বাদে আনোয়ারুল হকের ডাক পড়ল। মতিন সাহেব দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলেন, বাবা তাঁর পেছনে। ছিমছাম সাজানো রুম, টেবিলে অনেক মেডিকেল সরঞ্জামে পূর্ণ। পাশে একটি বেড পরিপাটি গোছানো। ডাক্তার সাহেব হালকা–পাতলা গড়নের অত্যন্ত মার্জিত রুচিশীল মনের। মতিন সাহেবের চেয়ে চার পাঁচ বছরের বড় হবেন, সালাম দিলেন।

ডাক্তার সাহেব রোগীর নাম লেখা স্লিপ হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করছিলেন। ওয়ালাইকুম সালাম বলেই আনোয়ারুল হককে দেখে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে গেলেন। সামনে এগিয়ে এসে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘স্যার, আমি মুহিত’।

‘কোন মুহিত’?
‘আপনার ছাত্র মুহিত’।
‘বাবা, ৩৫ বছর শিক্ষকতা করেছি, কত ছাত্র পড়িয়েছি, অনেকে এসে মাঝে মাঝে দেখা করত তাদেরকে দেখলে হয়তো চিনব কিন্তু তুমি?’ বলে প্রশ্নের দৃষ্টিতে তাকালেন।

‘স্যার, আমি মোহনপুরের সিরাজ গাজীর ছেলে। আপনার স্কুল থেকে ১৯৯৫ সালে প্রথম বিভাগে পাস করি। কলেজে ভর্তি হওয়ার টাকা ছিল না, পড়াশোনা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলো। আপনি ভর্তি ফির টাকা দিয়ে উপজেলা সদরের কলেজে ভর্তি করে দিলেন!’

‘হ্যাঁ রে বাবা, এইবার চিনতে পারছি।’
ডাক্তার সাহেব বাবাকে টেনে নিয়ে নিজের চেয়ারে বসালেন, নিজে দাঁড়িয়ে বাবার হাত দেখতে দেখতে বলেন, ‘স্যার, আমার এই দীর্ঘ জীবনে বহু শিক্ষক পেয়েছি কিন্তু আপনার মতো আন্তরিক নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক আর পাইনি।

দীর্ঘদিন দেশের বাইরে ছিলাম। বাবা–মা বেচে নেই। ছোট ভাইটা পড়াশোনা করে কানাডায় সেটেল্ড হয়েছে। দেশে যাওয়া হয় না অনেক দিন, তাই আপনার খোঁজখবর নিতে পারি নাই, স্যার। আমাকে ক্ষমা করবেন, স্যার।’

হক সাহেবের মুখে আর কোনো কথা এল না, স্নেহের দৃষ্টিতে ডাক্তার সাহেবের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
মতিন সাহেব দেখলেন, নিজের প্রশংসা শুনে আত্মতৃপ্তিতে বাবার চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে তৃপ্তাশ্রু।

যাত্রাবাড়ী, ঢাকা