তারুণ্যের মাঝেই বেঁচে থাকি
তারুণ্য মানবজীবনের নিয়ামক শক্তি। জীবনের অনুকূল কিংবা প্রতিকূল পরিবেশে এই তারুণ্যই কার্যত নির্দেশক হিসেবে কাজ করে বিপৎসংকুল-বন্ধুর পথে। তারুণ্যই আমাদের পথ দেখায়। এটি এমনই এক প্রাণশক্তি, যার আশ্চর্য জাদুস্পর্শে সব বাঁধা ডিঙাতে পারে মানুষ। পারে অসম্ভবকে সম্ভব করতে, পারে অধরাকে মুঠিতলে আনতে। কবি নজরুল তারুণ্যের মধ্যে অবলোকন করেছেন জীবনের অমিত তেজ এবং অপার সম্ভাবনাকে। তারুণ্যের কাছে নিয়তিও হার মানে বলে মন্তব্য করেছিলেন কবি আল মাহমুদ। তরুণদের দুরন্তপনা, অসীম সাহস, নবসৃষ্টির উদ্দীপনা, পাহাড়সম বাধা-বিপত্তি ডিঙানোর মনোবল, অদম্য- দুর্বার গতিময়তাকে সাধারণত আমরা তারুণ্যশক্তি কিংবা তারুণ্য ধর্ম বিবেচনা করে থাকি। কেননা উল্লিখিত বৈশিষ্ট্যগুলো প্রধানত তরুণ বয়সই ধারণ করে থাকে। এই অমোঘ সত্যটিকে, মানদণ্ড ধরে কেউ কেউ তাই তারুণ্য এবং যৌবন-সীমাকে সমধর্মী দ্যোতনা দান করেন। তারা বলে থাকেন, ‘যতক্ষণ যৌবন, ততক্ষণই জীবন। বাকিটা পরহস্তগত।’ বিবেচনাটি অমূলক নয়। যৌবনসীমার মাঝেই মানুষ তার অমিত প্রাণশক্তির সফল রূপায়ণ ঘটাতে সক্ষম হয়। প্রৌঢ়ত্বে কিংবা বার্ধক্যের পর্বে শারীরিক অসামর্থ্য, জরা-ব্যাধি মানুষের মনোবলকেও স্তিমিত করে ফেলে। ফলে একই ব্যক্তি তরুণ বয়সে যে দুর্বার উদ্দীপনা নিয়ে কাজ করত, প্রতিকূলতাকে অনায়াসে করে তুলত জীবনের অনুগামী, নির্দিষ্ট বয়সসীমার পর সেই ব্যক্তিটির মনেই জন্ম নেয় দ্বিধা, মানসিক দুর্বলতা। যদিও কাজী নজরুল ইসলাম যুক্তিনিষ্ঠভাবেই তারুণ্য বা যৌবন-সীমাকে বয়সের ফ্রেমে বাঁধতে চাননি। তার বক্তব্যের সত্যতা আমরা খুঁজে পাই পৃথিবীর প্রতিটি সৃষ্টিশীল কালজয়ী মহামানবের জীবনচরিতে।
রবীন্দ্রনাথের অসাধারণ সৃষ্টি ‘শেষের কবিতা’র সামগ্রিক নির্মাণ-ভাবনা বিচার করলেই আমরা সহজে অনুধাবন করতে পারি তারুণ্য কেবল বয়সজাত কোনো প্রত্যয় নয়; এটি বরং মনোজাগতিক এক আশ্চর্য সঞ্জীবনী শক্তি, যা না থাকলে রবীন্দ্রনাথও হয়তো এমন দার্শনিক কাব্যধর্মী উপন্যাস সৃষ্টি করতে পারতেন না। তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে বয়সের সঙ্গে তারুণ্যশক্তির নিবিড় যোগ আছে। জীবন-জগতের দার্শনিক বীক্ষার আলোকে এই যোগসূত্রের কার্যকারণ সূত্র ব্যাখ্যা করা যায়। আবার বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির আলোকেও তা নিরূপণ করা যায়। কেননা শারীরিক শক্তি কিংবা সামর্থ্যের সঙ্গে মানসিক শক্তির একটি অনিবার্য সম্পর্ক আছে। ফলে তারুণ্যধর্মও নিবিড়ভাবে এই কার্যকারণ সূত্রের সাথে সম্পর্কিত, এটি হলো সাধারণ হিসাবের কথা। প্রথাগত বিবেচনায় বয়সসীমার বাইরে তারুণ্যকে আমরা নির্দ্বিধায় দৃষ্টান্তসহযোগে স্বীকার করেছি।
সার্বিক বিবেচনাতেই তারুণ্যকে মানবজীবনের অপরিত্যাজ্য এবং মৌল প্রেরণারূপে দেখতে পাই। এই প্রেরণা ছাড়া জীবন মূলত অসার, প্রাণহীন, অকার্যকর এক বস্তু, যা অত্যন্ত দুর্বহ এবং অভিশাপের নামান্তর। তারুণ্য শক্তিহীন মানুষ ক্রমে বিভীষিকাময় অন্ধকারে তলিয়ে যায় দুঃসহ যন্ত্রণা আর মানবজন্মের ব্যর্থতার হাহাকার নিয়ে। অপর দিকে, তারুণ্যে উজ্জীবিত, দেদীপ্যমান একজন মানুষ অন্ধকার বিদীর্ণ করে চিরন্তন আলোকশিখা জ্বালিয়ে রাখে। সব ধরনের জঞ্জাল সরিয়ে মানুষ, সমাজ, পৃথিবীকে করে নির্মল-সুশোভন। তাই তারুণ্যই চির আরাধ্য মানুষের কাছে।
তারুণ্যই জীবনকে মহাজীবনের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যায়। জীবনের চালিকা শক্তিরূপে আমরা তাই এই শক্তিকেই আবাহন করি, অবচেতনে হলেও করি এই ধর্মের স্তুতিগান। জ্ঞাতসারে, অজ্ঞাতসারে মানুষ যেন এই নিয়ামক শক্তির মধ্যে কিংবা এর স্মৃতির মধ্যে বেঁচে থাকে। কেউবা আবার চিরতরুণ থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করে থাকেন প্রাণপণে, যদিও বয়স ধরে রাখার কোনো টনিক নেই; তবুও মানুষ যেন কায়মনোবাক্যে অস্ফুট স্বরে তার জীবনদেবতার কাছে এই বরটিই প্রত্যাশা করে! এই তরুণদের চোখমুখে অফুরান স্বপ্ন খেলা করে । সংশয়-শঙ্কাহীন তরুণ প্রাণ ঝুঁকি নেওয়ার দুঃসাহস পোষণ করে। কিশোর কবি সুকান্তর ‘এ দেশের বুকে আঠারো আসুক নেমে’ পঙ্ক্তির মধ্যে একটি তাৎপর্যপূর্ণ সমষ্টির প্রাণের, প্রত্যাশার, অভিব্যক্তির প্রতিধ্বনি শুনি। এই স্বপ্ন যেন শুধু কবির নয়, আমাদের সব মানুষের!
মানবসভ্যতার ইতিহাস মূলত তারুণ্যের ইতিহাস। সমাজ-সভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারায় এই শক্তির ইতিবাচক ভূমিকার কথা অনস্বীকার্য। এই শক্তির স্বতঃস্ফূর্ত প্রেরণার মর্মমূলেই ব্যক্তি, পরিবার, রাষ্ট্র, সমাজ, পৃথিবীর সুস্থ-স্বাভাবিক বিকাশ নিহিত। দিনবদলের, সমাজ-রাষ্ট্র কাঠামোর পরিবর্তন কিংবা রূপান্তর সাধনের স্বপ্ন এবং প্রয়াস তরুণদের মধ্যেই প্রধানত ক্রিয়াশীল থাকে। ভয়-শঙ্কাহীন তরুণদের নবসৃষ্টির উন্মাদনা তাদের সমাজ-রাষ্ট্র তথা পৃথিবীর জন্য কল্যাণকর। এই তারুণ্যশক্তির সঙ্গে সত্য, সুন্দর, ন্যায়, কল্যাণ ও শুভবোধ যুক্ত হলে তা হয়ে ওঠে মানবসভ্যতার উৎকর্ষের মুখ্য নিয়ামক।
বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বয়সে তরুণ। তাদের মানসে শাশ্বত তারুণ্যের বাস। তাদের মনোজগতে সমাজ পরিবর্তনের অদম্য প্রত্যয়। এই তরুণ প্রজন্মের চোখে আমরা আগামীর বাংলাদেশ এবং অনাগত পৃথিবীর প্রতিচ্ছবি প্রত্যক্ষ করি। পশ্চিম আকাশে নুয়ে পড়া দিবসের অস্তগামী সূর্য যেমন পূর্ব আকাশের নবসূর্য উদয়ের প্রতীক্ষা করে, তেমন একজন বয়োবৃদ্ধ মানুষও জীবনসায়াহ্নে উপনীত হয়ে উত্তর প্রজন্মের কিশোর-তরুণ-যুবাদের মধ্য দিয়েই নিজের অসমাপ্ত স্বপ্ন পূরণের প্রত্যাশা করে। মানবজীবনের পথ-পরিক্রমায় এটিই যেন মানুষের অনিবার্য নিয়তি হয়ে ওঠে। ফলে তরুণ প্রজন্ম সমাজ-রাষ্ট্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ জনগোষ্ঠী।
তারুণ্য শক্তিই কার্যত জীবনের প্রাণ প্রবাহ। এটি ফল্গুধারার মতো বয়ে চলে সব কালে, সব সমাজে, সব সভ্যতায়। এটির একটি শাশ্বত স্বরূপ আছে। এই স্বরূপের মৌল উপাদান অফুরন্ত প্রাণশক্তি। এই চির আরাধ্য তারুণ্যের মধ্যেই মানুষের শেষ আশ্রয়। আমরা তাই এই শক্তির সুধারসে নিরন্তর অবগাহন করি, স্বপ্ন দেখি দিন বদলের। পুঁজিবাদী বিশ্ব ব্যবস্থায় টালমাটাল সময়ে মানবিক পৃথিবী গড়ার প্রত্যয়দীপ্ত প্রতিধ্বনির সাথে ঐকতান গড়ি তাদের সাথেই প্রকৃত অর্থে যে মানুষ তারুণ্যকে ধারণ করে ।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়