তরুণ তোমার পথের ঠিকানা

তারুণ্যের বড় কথা হলো লক্ষ্য নির্ধারণ এবং সেদিকে নিরলস চেষ্টায় এগিয়ে যাওয়া
ফাইল ছবি

কৈশোরের চপলতা তারুণ্যে এসে ডালপালা মেলে। মানুষের ভবিষ্যৎ জীবন গড়ার শেষ সোপান তারুণ্য। এখানে এসে ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় তরুণদের লক্ষ্য নির্ধারিত হয়ে যায়। যাঁরা পড়াশোনায় ভালো, কৃতী ছাত্র, তাঁদের বিগত বছরগুলোর কষ্টের ফসল হাতে এসে ধরা দেয়। সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো ভালো বিষয়ে পড়ার সুযোগ হয় তাঁদের। আর যাঁরা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়েন, তাঁরাও কোনো না কোনোভাবে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ানোর সুযোগ করে নেন।

তারুণ্যের বড় কথা হলো লক্ষ্য নির্ধারণ এবং সেদিকে নিরলস চেষ্টায় এগিয়ে যাওয়া। মানুষের জীবনে সবচেয়ে শ্রম দেওয়ার সময় হচ্ছে তারুণ্য। এ বয়সই মানুষের কাছে অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলে। কবি হেলাল হাফিজ যথার্থই লিখেছেন, ‘এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’।

কিন্তু যুদ্ধ তো আর এমনি এমনি হবে না, সাজ–সরঞ্জাম আর হাতিয়ার লাগবে। তরুণের এ সাজ-সরঞ্জাম তাঁর বিদ্যা ও বুদ্ধি। হাতিয়ার তাঁর পুস্তকলব্ধ ব্যবহারিক জ্ঞান। প্রযুক্তির উৎকর্ষের কল্যাণে এখন বইয়ের বাইরেও জ্ঞান আহরণের সুযোগের কমতি নেই। ইন্টারনেটের দুনিয়াজোড়া জাল তরুণদের জন্য জ্ঞান আহরণের অজস্র দ্বার খুলে রেখেছে। আবার ফেসবুকের মোহজালে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় অপচয়ের মোহজালের ফাঁদও কম নেই। যেকোনো আসক্তি তারুণ্য ধ্বংস করে। আজকের কাজ কালকের জন্য ফেলে রাখার বাতিক তারুণ্যে অপরিমেয় শক্তির অপচয় করে। সেদিকে কঠোর দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন। কারণ, জীবন এক বহতা নদী। সময় ফুরিয়ে গেলে আর ফিরে পাওয়া যাবে না।

তরুণদের পথচলায় ভালো দিশারি হতে পারে বই। পৃথিবীতে একটি ভালো বইয়ের মতো পরম বন্ধু আর নেই। বিশেষ করে জ্ঞানী–গুণী আর কীর্তিমান মানুষের জীবনী পড়লে তা বিভিন্ন ক্ষেত্রে নানাভাবে অনুপ্রেরণা জোগায়।

বিশ্বে পেশাগত জীবনে সফল ব্যক্তিদের একজন মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস। দুনিয়াজুড়ে অসংখ্য তরুণ তাঁর ভক্ত। ক্যারিয়ার গঠনে প্রতিভাদীপ্ত অনেক তরুণ বিল গেটসের আদর্শ অনুসরণের চেষ্টা করে থাকেন। সেই গেটস বলেন, ‘আমি জ্ঞানদাতা নই, একজন শিক্ষার্থী মাত্র। আমার পেশার যে বিষয় আমি সবচেয়ে বেশি পছন্দ করি, তা হচ্ছে, শিখতে আগ্রহী লোকজন ঘিরে আছে আমাকে।’

গেটস আরও বলেন, যেসব মানুষ রাতে মাত্র তিন-চার ঘণ্টা ঘুমানোর অভ্যাস রপ্ত করে ফেলেছেন, তাঁদের ঈর্ষা করেন তিনি। কারণ, তাঁরা বেশি করে শেখার ও পড়ার সুযোগ পান।

বিল গেটসের এ কথা থেকে বোঝা যায়, অর্থবিত্তের মধ্যে থেকেও কতটা জ্ঞানপিপাসু তিনি। তাই বলে গেটস যে খুব ভালো ছাত্র ছিলেন, তা নয়। বরং শৈশবে তাঁর পড়াশোনা নিয়ে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয়েছে। ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় তাঁকে মনোচিকিৎসকের কাছেও নিয়ে যাওয়া হয়। চিকিৎসক অনেক দিন তাঁকে পর্যবেক্ষণ করে মা-বাবাকে বললেন, ওর ওপর চাপ প্রয়োগ করা বৃথা, ও যা করার নিজ থেকেই করবে।

পরবর্তী সময়ে দেখা গেছে, বিল গেটস খ্যাতিমান ব্যক্তিদের জীবনী পড়তে শুরু করেন। তাঁদের জীবনধারা ও গুণাবলি থেকে রসদ নিতে থাকেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট এবং ফরাসি বীর নেপোলিয়নের জীবন তাঁকে বিশেষভাবে আকর্ষণ করে। এ ছাড়া বিজ্ঞানের নানা বিষয়ে ছিল তাঁর গভীর আগ্রহ। এই আগ্রহ আর একাগ্রতাই তাঁকে এত দূর নিয়ে আসে।

বিজলি বাতির আবিষ্কারক টমাস আলভা এডিসন প্রতিদিন গড়ে ১৬ ঘণ্টা কাজ করতেন। আপেক্ষিক তত্ত্বের জনক আইনস্টাইন তাঁর গবেষণায় এমনভাবে ডুবে থাকতেন যে নাওয়া-খাওয়ার কথাও ভুলে যেতেন। একদিন দুপুরে তাঁর এক ভাগনি গেছেন দেখা করতে। দেখেন যে মামা আইনস্টাইন একটিমাত্র ডিম সেদ্ধ দিয়েছেন দুপুরের খাবারের জন্য। ওই ডিমে মুরগির বিষ্ঠা লেগে আছে। সেটা ধুয়ে নেওয়ার সময়ও নেই তাঁর।

এভাবে বড় বড় মনীষীর জীবন পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তাঁরা খেয়ে না খেয়ে সময়ের মূল্য দিয়েছেন। এটা ঠিক যে ‘আমাকে মনীষী হতেই হবে, খ্যাতি অর্জন করতেই হবে’, এমন কোনো কথা নেই। তবে নিজের জীবনটাকে সুন্দর করে সাজাতে দোষ কী?

মার্ক টোয়েন বলেছেন, জীবনের পড়ন্ত বেলায় এসে ২০ বছর আগের এমন ঘটনার জন্য ভয়ানক আফসোস হতে পারে, সুযোগ থাকা সত্ত্বেও জীবন পাল্টে দেওয়ার মতো যে কাজ করা হয়নি।

কাজেই সুন্দর ভবিষ্যতের ঠিকানা নিশ্চিত করতে সঠিক পথে তরুণদের চলার এখনই মোক্ষম সময়। আর এ জন্য যে একজন তরুণকে খুব বেশি কঠিন কাজ করতে হবে, তা কিন্তু নয়।

অনেকেরই ভারি বিচ্ছিরি স্বভাব হলো ঘুম থেকে দেরিতে ওঠা। এই অভ্যাস মানুষের জীবনে চলার পথে প্রথম বাধা। সবচেয়ে ভালো ভোর পাঁচটা থেকে ছয়টার মধ্যে ওঠা। এ সময় প্রকৃতি ও পরিবেশ থাকে শান্ত। মনমেজাজ থাকে তরতাজা আর সতেজ। এ সময় যেকোনো কাজ সুন্দরভাবে শুরু করা যায়। অন্যভাবে বলা যায়, এ সময়ের কাজ খুব দ্রুত আগায় এবং কাজের ফলও ভালো পাওয়া যায়। প্রখ্যাত দুই কথাশিল্পী সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এবং হুমায়ূন আহমেদ–দুজনই খুব ভোরে উঠে লিখতে বসতেন।

তরুণ বয়সে অনেকেরই নানা বিষয়ের দিকে ঝোঁক থাকে। এর ভালোমন্দ দুটোই আছে। যেমন–কারও যদি বই পড়ার ঝোঁক থাকে, সেটা অবশ্যই একটি ভালো অভ্যাস। এতে জ্ঞান বাড়বে, দিন–দুনিয়ার হালচালের বিষয়ে সচেতনতা বাড়বে। কিন্তু যদি কেউ স্যাটেলাইট টিভির স্টার জলসা বা এ ধরনের চ্যানেলের সিরিয়ালে চোখ বিঁধিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পড়ে থাকে, তাহলে তাঁর ভবিষ্যত অন্ধকার।

অনেক তরুণ প্রায় সারাক্ষণ মুঠোফোন নিয়ে পড়ে থাকেন। ফেসবুক আর ইউটিউবের নেশা তাঁকে পেয়ে বসে, যা ক্ষতিকর। তবে হ্যাঁ, ইন্টারনেট ঘেঁটে মেধা ও মনন সমৃদ্ধ করার মতো কোনো তাত্ত্বিক জ্ঞান আহরণ করাটা অবশ্যই সমর্থনযোগ্য। তবে এ কথা মনে রাখতে হবে যে মুঠোফোন বা কম্পিউটারের মতো বৈদ্যুতিক যন্ত্রের অতি ব্যবহার মস্তিষ্কসহ মানবদেহের নানা অঙ্গের জন্য ক্ষতিকর। কাজেই মাত্রা থাকাটা বাঞ্ছনীয়।

তরণদের অনেকেই ট্রেন, বাস ও নৌপথে দীর্ঘ ভ্রমণ করে থাকেন। এ সময় কিন্তু ভালো সঙ্গী হতে পারে বই। যে বই পেশাগত জীবনের জন্য সহায়ক কিছু হতে পারে, জ্ঞান–বিজ্ঞানের হতে পারে, ভালো মানের গল্প-উপন্যাস হলেও তো ক্ষতি নেই।

তরুণ বয়সে পানাহারের দিকে লক্ষ রাখাটা জরুরি। রোজকার জীবনের নিয়মিত খাবারের বাইরে কোনো কিছু খেতে বা পান করতে গেলে অবশ্যই ভেবে দেখা দরকার, আমি কী খাচ্ছি! এর ফল কী দাঁড়বে?

দেখা গেল, বন্ধুবান্ধব বা পরিচিত কারও পাল্লায় পড়ে একটু-আধটু সেবন করে মাদকের মরণনেশা হয়ে গেল। কাজেই এদিকে বিশেষ খেয়াল রাখা প্রয়োজন।

তরুণদের জন্য সবচেয়ে জরুরি হলো, আজকের কাজ কালকের জন্য ফেলে না রাখা। যেমন–একটা গুরুত্বপূর্ণ পাঠ তৈরি করা প্রয়োজন। সেটা করতে গিয়ে আলসেমি ধরতে পারে। মনে হতে পারে, এখন একটু বিশ্রাম নিই, পরে নাহয় পড়ে নেব। পরে আবার মনে হবে, আজ থাক, সময় যখন আছে, কালকেই নাহয় হবে। এ ধরনের আলসেমি বড় সর্বনেশে! আসলে এই ‘কাল’ কিন্তু সহজে আর আসে না। এভাবেই পিছিয়ে পড়ে সব কাজ, যা তরুণকে জীবনের সঠিক পথ ও সুনির্দিষ্ট ঠিকানা থেকে অনেক দূরে ঠেলে দিতে পারে। কাজেই সময় থাকতে সাবধান!