তপুর ‘বৈশাখী মেলা’

প্রতীকী ছবি
অলংকরণ: স্বপন চারুশি

রাত পোহালেই কাল পহেলা বৈশাখের মেলা।

তপুর আজ যেন কোনোভাবেই দিন কাটছে না। প্রতি মুহূর্ত যেন একেকটা শতাব্দীর মতো বড় মনে হচ্ছে।

পুরো সময় অস্থির লাগছে তার!

রাত যেন আরও বিশাল, রাতে কতবার যে ঘুম থেকে উঠে মাকে ডেকে বলেছে, ‘মা দেখো তো সকাল হলো কি না। কখন সকাল হবে? আর কতক্ষণ রাত আছে?’

মা তো অস্থির হয়ে বকা দিতে শুরু করেছেন।

সেদিন তপু ঘুমায়নি সারা রাত, মাকেও ঘুমাতে দেয়নি।

তপু এবার মেলার জন্য পরিকল্পনা করেছে, সকালে উঠেই সবার আগে গোসল করে রেডি হবে, খাওয়াদাওয়া করলে করবে, না করলে নাই।

বাবা তপুর পছন্দের সবুজ পাঞ্জাবি কিনে নিয়ে এসেছেন, সেটা পরেই দেবে ভোঁ–দৌড়। একদৌড়ে একদম মেলায় চলে যাবে।

মোটকথা সবার আগে মেলায় যাবে। মেলায় গিয়ে নাগরদোলায় চড়বে, পান্তা–ইলিশ খাবে, সারা দিন ঘুরবে।

সঙ্গে মাটির জিনিস কিনবে; বাঁশি, ঢোল, গাড়ি এসব তো আছেই!

বৈশাখী মেলায় যাবে ভেবে অনেক দিন আগে থেকেই টাকা জমিয়েছিল তপু।

বন্ধুদের সঙ্গে মাঠে গিয়ে যাউন ছবের (একধরনের মসলা) গাছ কুড়িয়েছিল। সঙ্গে ভেন্নার বীজ (একধরনের তেলবীজ) কুড়িয়েছিল।

যাউন হয়েছিল ছয় কেজি এবং ভেন্নাবীজ হয়েছিল তিন কেজি, এটাই তার মূল সঞ্চয়।

যাউন বিক্রি করেছিল ২৫ টাকা কেজি এবং ভেন্না ৪০ টাকা কেজি। সর্বমোট পেয়েছিল ২৭০ টাকা।

আরও ভেবে রেখেছে, বাবার কাছ থেকে ২০০ টাকা নেবে। মায়ের কাছ থেকে নেবে ১০০ টাকা, নানা–নানির থেকে নেবে ১০০ টাকা। সবার কাছে থেকে চাঁদা তুলে মোট হয়েছে ৬৭০ টাকা!

এখন মেলায় যাওয়ার পালা!

এর মধ্যে তপুর ছোট ভাইও পিছু নিয়েছে মেলায় যাবে বলে। তাকে ৭০ টাকা দিয়ে কোনোমতে এ যাত্রায় বেঁচেছে তপু।

তপু এখন একাই মেলায় যাচ্ছে।

এখন তার কাছে রয়েছে ৬০০ টাকা।

তপুর কী যে আনন্দ লাগছে, ভাষায় প্রকাশ করার সাধ্য নেই কারও। মেলায় গিয়ে অনেক আনন্দ করবে সে, সারা দিন ঘুরবে, শখের অনেক জিনিস কিনবে।

তপু মেলায় যাওয়ার রাস্তায় হাঁটছে আর টাকা ভাগ করে নিচ্ছে কয় টাকায় কী কী কিনবে।

পান্তা–ইলিশ ১০০ টাকা প্লেট নেয়, গিয়েই আগে পান্তা–ইলিশ খাবে।

৫০ টাকা দিয়ে একটা ঢোল কিনবে।

১০০ টাকা দিয়ে ব্যাট–বল কিনবে।

৫০ টাকা দিয়ে একটা রঙিন চশমা নেবে।

মাটির জিনিস ও বাঁশি কিনবে, সেখানে ধরে রাখল ১০০ টাকা। টিকিট কেটে পুতুলখেলা দেখবে, মঞ্চনাটক দেখবে, নাগরদোলায় চড়বে; সেখানে খরচ হবে ১০০ টাকা।

বাকি ১০০ টাকা দিয়ে বাড়ির জন্য সাজ্জনা মিষ্টি এবং গুড়মিশ্রিত মুড়ি কিনবে!

অনেক হিসাব করে মেলায় যাচ্ছে তপু। মনটা অন্য রকম আনন্দে ভরপুর।

রাস্তায় যাওয়ার পথে কিছু বন্ধুর সঙ্গে দেখা হলো তপুর।

সবার কাছে শুনে নিল কে কী করবে, কী কিনবে।

সবার চেয়ে তপুর পকেটে টাকা বেশি, ওর আনন্দ সবার চেয়ে বেশি।

তপু ও তার বন্ধুরা নৌকায় করে মেলায় গেছে। নৌকা থেকে নেমেই দেখল হরেক রকম দোকান সাজিয়ে বসে আছেন দোকানিরা।

দেখতে অসম্ভব সুন্দর লাগছে!

মেলায় যাবে, এমন সময় দেখল, এক পাশে অনেক লোকের ভিড় জমে আছে। কৌতূহলবশত সেখানে তপু ও তপুর এক বন্ধু এগিয়ে গেল।

সেখানে গিয়ে খেয়াল করল, ফিতা দিয়ে একধরনের বাজি খেলা চলছে! সেখানে ৫০ টাকা ধরলে ১০০ টাকা দেয়, ১০০ ধরলে ২০০ আর ২০০ ধরলে ৫০০ টাকা বাজি।

খেলাটার নিয়ম হচ্ছে, ফিতা পেঁচিয়ে দেবে, তিনটা গোল মাথা থাকবে, সেখানে একটা কাঠি দিয়ে যেকোনো একটা গোল মাথায় বসাতে হবে। তারপর ফিতা টান দিতে হবে। যদি ফিতার সঙ্গে কাঠি আটকে যায়, তাহলে অপরজন বাজিতে জিততে পারবে, না আটকালে হেরে যাবে।

তপু কিছুক্ষণ দেখল খেলাটা। বাহ্! যখনই কাঠি দেয়, তখনই আটকায়।

তপুর সামনেই দুজন অনেক টাকা পেয়ে গেল।

এত সহজ খেলা জীবনেও কল্পনা করেনি তপু, ধরলেই টাকা পাওয়া যায়।

সঙ্গে থাকা বন্ধু বুদ্ধি দিল, ‘দোস্ত টাকা ধর, আমিও ধরব।’

শুনেই তপুর লোভ জন্মে গেল!

তপু ভাবল, ‘আমিও টাকা লাভ করব। ৬০০ টাকা আছে, যদি কিছু লাভ করতে পারি, তাহলে তো আরও শখের জিনিস কিনতে পারব!’

সঙ্গের সবাই চলে গেছে। তপু আর তার বন্ধু সেখানেই নেশায় পড়ে গেল।

প্রথমে ৫০ টাকা ধরল, সঙ্গে সঙ্গেই টাকাটা চলে গেল। কাঠিতে ফিতা আটকে নেই।

আবার ৫০ টাকা ধরল, সেই টাকাও চলে গেল!

তপু ভাবল, ‘ইশ্‌, কী হলো! আমার ফিতার প্যাঁচ তো ঠিকঠাকই আছে। ঐ লোক বারবার যেটায় আটকিয়ে টাকা পেল, আমি তো সেটাতেই দিচ্ছি! আটকায় না কেন?’

তপু এবার ফিতার মাথা পরিবর্তন করে কাঠি দিল। এবার টাকা ধরল ১০০।

এবারও চলে গেল!

তপুর মনে মনে জেদ উঠে গেল। ‘এ টাকা আমি তুলেই ছাড়ব!’

তারপর আবার ধরল ১০০ টাকা। সেটাও চলে গেল!

রাগ আরও তীব্র হতে লাগল। রাগে মাথা ভনভন করছে। এত আনন্দ করে মেলায় এসেছে সে, এখন সব আনন্দ মাটি হয়ে গেল।

এবার সিদ্ধান্ত নিল, আর একবার ১০০ টাকা ধরবে। যদি জিতে যায়, তাহলে আরও একবার ধরবে। যদি জিততে না পারে, তাহলে চলে যাবে।

আবার ১০০ টাকা ধরল, এবারও চলে গেল!

বেচারা সহজ–সরল তপু বুঝতেই পারেনি, এটা তাদের একটা চালাকি ছিল।

বোকার মতো লোভে পড়ে সব টাকা হারিয়ে ফেলল।

রাগে, দুঃখে বুক ফেটে কান্না আসতে শুরু করল তার। কী করবে কিছুই বুঝতে পারছে না! ফর্সা মুখ একদম শুকিয়ে কালো হয়ে গেছে।

কোনো রকমে নিজেকে সামলে নিয়ে কান্না চাপিয়ে রেখেছে লোকলজ্জায়।

চোখে জলও এসেছিল! লজ্জা লুকাতে গিয়ে টিউবওয়েল থেকে পানি নিয়ে মুখ ধুয়েছে।

তারপর সে ওখান থেকে চলে এসে নৌকায় বসে রইল, কাউকে কিছু বলল না।

ওরা যারা একসঙ্গে এসেছিল, তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি টাকা তপুর কাছেই ছিল। আনন্দটাও অন্য সবার চেয়ে বেশি ছিল ওর।

এখন সবাই হাসিখুশি, শুধু তপু নীরব।

অনেকে প্রশ্ন করল, কী হয়েছে। সে উত্তরে বলল, কিছু হয়নি।

সবাই তো আর বোকা নয়। বলল, ‘কী হয়েছে? বলো! কোনো সমস্যা হলে বলো, সাহায্য করব।’

তপু তখন লজ্জায় মিথ্যা বলল, টাকা হারিয়ে গেছে, তাই মন খারাপ।

মিথ্যা না বললে সবাই উপহাস করত আর ওর বাসায় বলে দিত। বাসায় শুনলে তো মেরে বস্তা ফাটিয়ে দেবে!

আর হারানোর কথা বললে বড়জোর দুই–একটা বকা দেবে, মার দেবে না। সে জন্য মিথ্যা বলল তপু।

ফেরার সময় বাকি ২০০ টাকা ছিল। তা থেকে ছোট ভাইয়ের জন্য দুটো খেলনা কিনল তপু। ভাইটা মেলায় আসার সময় বায়না ধরেছিল। মা ওর জন্য কিছু একটা নিতে বলছিলেন। না নিলে আরও বেশি বকা খাবে, তাই ওর জন্য বন্দুক আর একটা ছোট গাড়ি এবং কিছু মোয়া-মিঠেমুড়ি নিয়ে ফিরল।

চিলমারী, কুড়িগ্রাম