টুনাটুনির ইচ্ছা

টুনাটুনির ইচ্ছা । ছবি: হাসান মাহমুদ

একটি ছোট্ট গাছের ডালে টুনা ও টুনি বাসা বাঁধার সিদ্ধান্ত নিল। বনে বনে আর কত ঘুরে বেড়াবে? দুজনেরই বয়স হয়েছে; এখন একটা স্থায়ী ঠিকানা দরকার। তাই তারা ঘর বাঁধতে চায়; সংসার পাততে চায়। তাদের মিলনে আসবে আরও কত না সন্তান–সন্ততি। সেই সন্তানেরা কিচিরমিচির করে চোখের সামনে উড়ে বেড়াবে। আর সেই আনন্দ মুহূর্তটুকু টুনা ও টুনি দূর থেকে প্রাণভরে দেখবে। তারা যখন বৃদ্ধ হয়ে যাবে, তখন তাদের সন্তানেরা যত্ন–আত্তি করবে। এমন নানাবিধ কথাবার্তা একে অপরের সঙ্গে বলাবলি করছে।

এরপর নতুন বাসার কাজ শুরু করল। দীর্ঘদিন টুনাটুনির কঠোর পরিশ্রমের ফলে বাসা নির্মাণের কাজ সম্পন্ন হলো।
টুনা ও টুনি চিন্তা করল, পরে কোনো পাখি যেন খোঁটা দিতে না পারে, আমরা নতুন ঘর নির্মাণের সময় কাউকে কিছু খাওয়াইনি বলে।
তাই অসংখ্য পরিচিত আত্মীয়কে দাওয়াত করে নতুন বাসায় আমন্ত্রণ জানাল। অতিথিরা বাসায় এল। লাল ফিতা কেটে উদ্বোধন করল। টুনা ও টুনি সেই অনুষ্ঠানে কোনো কার্পণ্য করেনি। বেশ জাঁকজমকভাবে অনুষ্ঠান সম্পন্ন করল।
এরপর থেকে টুনা ও টুনি একসঙ্গে থাকতে শুরু করে। কিছুদিন পর টুনি সেই বাসার ভেতর দুটি ডিম পাড়ে। সেই ডিম দেখে টুনা আনন্দে আটখানা। তাদের অনাগত সন্তানদের নিয়ে নানান চিন্তাভাবনা শুরু করে। টুনি ও টুনা সম্মিলিতভাবে ডিমে তা দেওয়া শুরু করে। তার কিছুদিন পর সেই ডিম থেকে দুটি ফুটফুটে ছেলে বাচ্চার জন্ম হয়। টুনা ও টুনি এত উচ্ছ্বসিত হয়েছে যে তারা আবারও সব আত্মীয়স্বজন শুভাকাঙ্ক্ষীকে দাওয়াত করে বিরাট আয়োজন করে। সব আত্মীয়স্বজন এসে তাদের সন্তানদের মুখ দেখে এবং দীর্ঘ হায়াতের জন্য দোয়া করে যায়।

সেই সন্তানদের বড় করে তুলতে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস বনে বনে ঘুরে ঘুরে আহার সংগ্রহ করে বাচ্চাদের মুখে খাবার তুলে দেয়। রোদ, ঝড়-বৃষ্টিতে তাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব কাঁধে নেয়। নিজে না খেয়ে সন্তানের মুখে খাবার তুলে দেয়। শত ঘাত–প্রতিঘাতের মধ্যেও টুনাটুনি পিছপা হয়নি কখনো। এভাবেই হাজারো পরিশ্রম করে সন্তানদের বড় করে তোলে, তারা হাঁটতে শেখে, কথা বলতে শেখে, উড়তে শিখতে, বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াতে শেখে, নিজে নিজে খাবার সংগ্রহ করে খেতে শেখে। তাদের সামনে কিচিরমিচির করে বেড়ায় বাবাকে বাবা আর মাকে মা ডাকে।
সময়ের বিবর্তনে সবকিছুই পাল্টেছে। তারা একদিন ভেবেছিল যে অসংখ্য সন্তানের পিতা–মাতা হবে। কিন্তু তাদের বর্তমান দুই সন্তানের সুখের কথা চিন্তা করে আর কোনো সন্তান নেয়নি। তাদের এখন বয়স হয়ে গেছে আর সন্তানই–বা আসবে কোথা থেকে।
সন্তানেরা আর আগের মতো নেই। তারা সবকিছু বুঝতে শিখেছে, নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখেছে, এভাবে আরও দীর্ঘদিন কেটে গেল। সন্তানেরা প্রাপ্তবয়স্ক হয়েছে, সারা দিন বনে–জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায়। এদিকে তাদের পিতা–মাতা সারা দিন কী হালতে আছে, তার কোনো খোঁজখবর নেয় না।
সন্তানেরা বাসায় ফেরার পর পিতা–মাতা জিজ্ঞেস করে, ‘তোমরা সারা দিন কোথায় ঘুরে বেড়াও? এদিকে যে আমরা দুজন আজ কয় দিন ধরে অসুস্থ হয়ে পড়ে আছি, সেদিকে তোমাদের কি কোনো খেয়াল আছে?’ সন্তানেরা উত্তর দেয়, ‘তোমাদের যথেষ্ট পরিমাণে বয়স হয়েছে। পাখিদের বয়স হলে একটু অসুস্থ থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। এত চিল্লাচিল্লি করবে না তো! অন্য পাখিরা ঘুমাচ্ছে। আর আমরাও সারা দিন ঘুরেফিরে খুব ক্লান্ত, এখন ঘুমাতে যাব। তোমরাও পারলে একটু ঘুমাও, না হলে যে তোমাদের কিচিরমিচির শব্দে আমরাও ঘুমাতে পারব না। তোমরা আমাদের জন্য কী করেছ? একটি বাসায় গাদাগাদি করে ঘুমাতে হয়, জীবনে কোনো কিছুই সঞ্চয় করোনি, হই–হুল্লোড় আর বিলাসিতা করে সব শেষ করে রেখেছ।’

মা পাখিটি এবার উত্তর দেয়, ‘তোমরা আমাদের সঙ্গে এ রকম আচরণ করতে পারো না। কেননা, তোমার বাবার কোনো বাজে অভ্যাস ছিল না। তার সমস্ত জীবনীশক্তি তোমাদের পেছনে, আমার পেছনে ক্ষয় করেছে। তোমাদের ভরণপোষণ দিয়েছে। তোমাদের জন্য হাজারো পরিশ্রম করে একটি বাসা নির্মাণ করার চেষ্টা করছে। কিন্তু আমি অসুস্থ হয়ে যাওয়ার পর থেকে তার সব সময় আমার পেছনে খরচ করছে। আমাকে টানতে টানতে আজ সে–ও নিজে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আজ তোমরা কিছুই বুঝতে পারছ না। একদিন তোমরা ঠিকই বুঝতে পারবে; আমরা যেদিন থাকব না। দেখবে তোমাদেরও একদিন সন্তান হবে এবং তোমাদের সঙ্গেও যখন ঠিক একই রকম আচরণ করবে।’ সন্তানেরা উত্তর দেয়, ‘যদি আর একটি কথা বলো, তবে এক্ষুনি নিচে নামিয়ে দিয়ে আসব, আর কোনো দিন বাসায় তুলে আনব না।’ এরপর পিতা–মাতা দুজনই শান্ত হয়ে যায়। বুক চিরে কান্না আসে। এই বেদনা কারও কাছে প্রকাশ করতে পারে না। পুরুষ পাখিটি স্ত্রী পাখিটিকে সান্ত্বনা দেয়, ‘দুঃখ কোরো না, এ আমাদের কপালের লিখন; ভাগ্যের নির্মম পরিহাস। কত আশায় বুক বেঁধেছিলাম, ওরা একদিন পাখিদের মতো পাখি হবে, আমাদের দুঃখ–কষ্ট বুঝবে। কিন্তু ওরা পাখি হবে পারেনি। দোয়া করি, তবু ওরা ভালো থাকুক সব সময়।’
এভাবে আরও দীর্ঘদিন অতিবাহিত হয়। পুরুষ ও স্ত্রী পাখিটি জীবনের শেষ প্রান্তে চলে আসে। হঠাৎ একদিন পুরুষ পাখিটি শয্যায়। চিৎকার ও আহাজারি করে তার সন্তানদের মুখ শেষবারের মতো একবার দেখার জন্য। কিন্তু তা আর কীভাবে সম্ভব। তারা যে অন্য ডালে গিয়ে বাসা বেঁধেছে; নতুন করে সংসার পেতেছে, তাদেরই যে স্ত্রী আছে, সন্তান আছে, তাদের নিয়ে সর্বদা ব্যস্ত থাকে। পিতার মৃত্যুশয্যায় তার পাশে থাকার মতো সময় কই। এমনভাবে হাজারো আহাজারি করতে করতে পুরুষ পাখিটি মারা যায় পাহাড়সমান কষ্ট বুকে নিয়ে। সঙ্গে সঙ্গেই স্ত্রী পাখিটি চিৎকার দিয়ে বলে ওঠে, ‘ওগো তুমি একি করলে; এখন আমার কী হবে?’ স্বামীর মৃত্যুর কষ্ট সইতে না পেরে পুরুষ পাখিটির বুকের পরে সে–ও মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। এভাবেই দুটি পাখি দীর্ঘ সময় তাদের বাসায় মরে পড়ে থাকে। তাদের দেখার মতো কেউ নেই। আত্মীয়স্বজন দূরে থাক, তাদের সন্তানেরাও পাশে নেই। এ অবস্থায় কেউ তো কোনো খোঁজখবর নেয়নি।

মৃত্যুর পরেও না। হঠাৎ প্রতিবেশী একটি পাখি কৌতূহলবশত তাদের অসুস্থতার কথা জানতে আসে। এসে দেখতে পায় যে তারা মারা গেছে। সঙ্গে সঙ্গে ওই পাখিটি তারা দুজনের মৃত্যুর সংবাদ চারদিকে ছড়িয়ে দেয়। তখন সব পাখি জানতে পারে। তাদের দুই সন্তানও খবর শুনে আসে স্ত্রী–পুত্রসহ। সবাই কান্নায় ভেঙে পড়ে। এক ভাই আরেক ভাইকে জড়িয়ে ধরে কাঁদে আর বলে, ‘নিশ্চয়ই আমরা আমাদের পিতা–মাতার সঙ্গে অন্যায় করেছি। আমাদের এই পাপের কোনো ক্ষমা নেই।’ দুই ভাইয়ের সন্তানেরা তাদের পিতাদের কাছে এবার প্রশ্ন করে, ‘আমাদের যে দাদা–দাদিমা আছে, তা তো কোনো দিন বলোনি? তাদের আদর ও স্নেহ–ভালোবাসা থেকে আমাদের বঞ্চিত করেছ; নিশ্চয়ই আমরা তোমাদের সঙ্গে এরূপ আচরণ করব যে রূপ তোমরা তোমাদের পিতা–মাতার সঙ্গে করেছ।’ এবার দুই ভাই চিন্তা করে ও জীবনের সব ভুলভ্রান্তি বুঝতে পারে। কিন্তু সেই সঠিক পথটি বুঝতে বড্ড দেরি হয়ে গেল। যখন পিতা–মাতা এই দুনিয়া থেকে বিদায় নিল। ডুকরে ডুকরে কাঁদে আর অসহায় পিতা–মাতার প্রাণবিহীন দেহের দিকে তাকিয়ে সেই নসিহতের কথা মনে পড়ে। আর বলতে থাকে, ‘আমাদের মতো হতভাগা পাখি এই পৃথিবীতে আর যেন জন্ম না নেয়, সব পাখি পাখিদের মতো পাখি হয়ে উঠুক। তাদের পিতা–মাতাকে ভালোবাসুক, যত্ন–আত্তি করুক। পাখিদের সমাজ হয়ে উঠুক চির উজ্জ্বল ও সমৃদ্ধ।’