জোছনা ও জননীর গল্প

প্রতীকী ছবি। অলংকরণ: বাবুল হোসাইন সোহাগ

‘...পরিচয়ে আমি বাঙালি, আমার আছে ইতিহাস গর্বের-

কখনোই ভয় করিনাকো আমি উদ্যত কোনো খড়গের...।’

(সৈয়দ শামসুল হক)

জীবন বাঁচানোর জন্য মাদ্রাসার ছাত্র হিসেবে ভর্তি হতে গেছি শর্ষিনার পীর সাহেবের মাদ্রাসায়। মিলিটারিরা মাথায় গুলির বাক্স তুলে দিয়েছে। অকল্পনীয় ওজনের বাক্স মাথায় নিয়ে সৈন্যদের সঙ্গে বারহাট্টা থেকে হেঁটে এসেছি নেত্রকোনা পর্যন্ত। এক সকালে মিলিটারিদের একজন একটি সাগর কলা ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘কাল সকালে তোমাকে গুলি করে মারা হবে...। ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ উপন্যাসে যুদ্ধ দিনের কথা এভাবেই শুরু করেছেন হুমায়ূন আহমেদ।

প্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ কয়েক দশক ধরে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। রচনা করেছেন অনেক বিস্ময়কর ও বিচিত্র উপন্যাস। নির্মাণ করেছেন অসম্ভব জনপ্রিয় নাটক ও চলচ্চিত্র। বাংলা ছোটগল্পে এনেছেন এক নতুন মাত্রা। তার বিপুল সৃষ্টির মধ্যে অন্যতম উপন্যাস ‘জোছনা ও জননীর গল্প’।

নীলগঞ্জ হাইস্কুলের আরবি শিক্ষক মাওলানা ইরতাজ উদ্দিন কাশেমপুরী। তার ছোট ভাই শাহেদ। ভাইয়ের স্ত্রী আসমানী ও তাদের মেয়ে রুনিকে নিয়েই ‘জোছনা ও জননীর গল্প’। আর এদের ঘিরে আছে অসংখ্য চরিত্র, যারা প্রয়োজনে এসেছে আবার চলেও গেছে। জটিল ও নির্মম বিষয়গুলোকে কল্পনাতীত সুন্দরভাবে এনেছেন হ‌মায়ূন আহমেদ। অসম্ভব সৃষ্টিশীল মানুষেরা কেবল কঠিন বিষয়কে সহজ করে তুলতে পারেন।

গ্রামে বাস করেন মাওলানা ইরতাজ উদ্দিন। একজন সরলপ্রাণ মানুষ। ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তার ছোট ভাই শাহেদকে খুঁজতে ঢাকায় আসেন। উপন্যাসের শুরু এভাবেই।

ইরতাজ উদ্দিন স্কুলের শিক্ষক। মসজিদের ইমাম। পাকিস্তানের একনিষ্ঠ ভক্ত। তিনি নামাজের পর পাকিস্তানের জন্য দোয়া করেন। একসময় নিজের চোখে তাদের নৃশংসতা দেখেন। পাকিস্তানি বাহিনীর চরম অত্যাচার-নির্যাতনে ভীষণ কষ্ট পান। একদিন দেখেন পরেশ, মুকুল সাহাসহ হিন্দু সম্প্রদায়ের চারজনকে ধরে এনেছে। তাদের মুসলমান করা হবে। সবার সামনে উৎসব করে কলেমা পড়ানো হবে। খাতনা করা হবে। খতনা ভিডিও করা হবে। উল্লাসে চিৎকার করবে। মুসলমান হওয়ার পর এদের নাম হবে আব্দুর রহমান, আব্দুল কাদের, আব্দুল সালেহ, আব্দুল হক। অথচ ইরতাজ উদ্দিন জানেন প্রত্যেকে তার নিজের ধর্মবিশ্বাসে বিশ্বাসী। এখানে কোনো জবরদস্তি নেই।

২৫ মার্চের পর যাদের দাড়ি আছে কলমা জানে, এ রকম মুসলমানদের কিছু বলে না। চড়-থাপ্পড় দিয়ে ছেড়ে দেয়। এ সময় হিন্দু সম্প্রদায়েরও অনেকে ভয়ে দাড়ি রাখে টুপি পরে। কানে আতর দেয়। কিন্তু মিলিটারিরা লুঙ্গি খুলে দেখে। আবার নারীদের ক্ষেত্রে কুমারী, বিবাহিত, অবিবাহিত, বিধবা এসব তাদের কাছে কোনো ব্যাপার না। সবাই তাদের কাছে আওরাত। সবাইকে নির্বিচারে নির্যাতন করে। দেশীয় দুশমনেরা তাদের ধরে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে দেয়। মানুষ একটা পিঁপড়া দেখলেও তার গায়ে পাড়া দেয় না। আর এরা মানুষ মারছে পিঁপড়ার মতো।

এসব দেখে দেখে ইরতাজ উদ্দিন বিষন্ন হয়ে পড়েন। তিনি ঘোষণা করেন, জুমার নামাজ পাড়াবেন না। পরাধীন দেশে জুমার নামাজ হয় না। পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন বাসেতের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে ইরতাজ উদ্দিন বলেন, ‘আমি একজন খাঁটি মুসলমান। একজন খাঁটি মুসলমানের উচিত জালিম শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা।’ ক্যাপ্টেন বাসেত ইতরাজ উদ্দিনকে উলঙ্গ করে সারা গ্রাম ঘুরায়। শেষে তাকে সোহাগী নদীর পাড়ে হত্যা করে।

ইরতাজ উদ্দিন হাজার ইরতাজ উদ্দিনের প্রতীক। এরা প্রথমে পাকিস্তানকে সমর্থন করে। কিন্তু একসময় এ ঘোর থেকে বেরিয়ে আসে। বুঝতে পারে পাকিস্তানিরা অমানুষের অমানুষ! পশুরও পশু! অধমেরও অধম!

ইরতাজ উদ্দিনের ছোট ভাই শাহেদ। শাহেদ এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র। সে যুদ্ধ করেনি। কিন্তু এক দুর্বিষহ মানসিক যুদ্ধে তার ৯ মাস কেটেছে। বিহারি অফিসে কাজ করে। দেশের অবস্থা এমন, যেকোনো সময় যুদ্ধ বেধে যাবে। শাহেদের স্ত্রী আসমানি। দুজনের মধ্যে প্রায়ই খুনসুটি হয়। আবার একজন আরেকজনকে অনেক ভালোবাসে। কিন্তু একদিন অভিমানে বাসা ছেড়ে চলে যায় আসমানী। এক সন্ধ্যায় শাহেদ দেখে আসমানী বাসায় নেই। যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। সব জায়গায় খুঁজতে থাকে। কোথাও পায় না।

যুদ্ধের শুরুতেই আসমানী হারিয়ে যায়। ৯ মাস ভয়ংকর অনিশ্চয়তা ও আতঙ্কের মধ্যে আসমানীকে খুঁজতে থাকে শাহেদ। কিন্তু জীবনে একবার জট লাগলে আর খোলে না। যুদ্ধের বছর এমন অগণিত শাহেদ প্রিয়জনকে খুঁজে ফেরে। শাহেদ হচ্ছে অসংখ্য প্রিয়জন হারানোর একজন, আবার শাহেদ হচ্ছে বিশেষ ভাগ্যবানদেরও একজন। যুদ্ধ শেষে সে আসমানীকে ভারতে খুঁজে পেয়েছিল। শাহেদের মাধ্যমে যুদ্ধের পুরা সময়টাকে ধরে রাখা হয়েছে। কিন্তু অনেক শাহেদ আজও আপনজনদের খুঁজছে।

কংকন ও রুনি এ উপন্যাসের শিশু চরিত্র। হঠাৎ পাকিস্তানিরা কংকনদের এলাকা আক্রমণ কারে। ঘর থেকে বের হলে মৃত্যু। ঘরে থাকলেও মৃত্যু। ঢাকা শহরে আজরাইলের কোনো বিশ্রাম নেই। একসময় হাজারও মানুষের সঙ্গে মায়ের হাত ধরে বের হয় কংকন। পেছনে গুলি আর কামানের শব্দ। দিগ্‌বিদিক মানুষের ছোটাছুটি। কখন যে মায়ের হাত থেকে সে ছুটে যায়, কেউ টের পায়নি। নিয়তির অমোঘ নিয়মে আগরতলা শরণার্থীশিবিরে কংকনকেও খুঁজে পায় মা।

রুনি অনেক কষ্টে মা আসমানীর সঙ্গে শরণার্থী শিবিরে পৌঁছায়। শিবিরের অবস্থা ভয়াবহ অমানবিক। জীবনের কোনো ছিটেফোঁটা নেই। কোনো রকম জীবন বাঁচে, এর বেশি খাবার নেই। তা ছাড়া চুরি, ঝগড়াবিবাদ সারাক্ষণ লেগেই থাকে। ছোট্ট রুনি অনেক খারাপ কথা শেখে। আসমানীকে এসব অনেক কষ্ট দেয়। রুনি একদিন কার হাতে যেন সন্দেশ দেখে। মার কাছে সন্দেশ খেতে চায়। এ জন্য মাকে বারবার বিরক্ত করে। আসমানি প্রচণ্ড জোরে তাকে চড় দেয়। রাতে রুনির ভয়ানক জ্বর আসে। মা মনের কষ্টে শব্দহীন সারা রাত কাঁদতে থাকে। রুনি ঘুম থেকে উঠে বলে, মা আমি আর কোনো দিন সন্দেশ খাব না। রুনির কথায় সমস্ত শরীর ভেঙে কান্না আসে আসমানীর। উপন্যাসে রুনি, আসমানী, কংকন, কংকনের মা এরা প্রতীকী হিসেবে এসেছে। এটি হলো এক কোটি শরণার্থী মানুষের জীবনের চিত্র।

এ উপন্যাসে মুনাফেক হচ্ছে কলিমুল্লাহ। সে রাজাকারদের প্রতিনিধি। দেশের মানুষদের ধরিয়ে দেয়। হিন্দুদের বাড়ি দখল করে। একেবারে যুদ্ধের শেষ সময় বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে। পাকিস্তানি গোয়েন্দা জোহর। যুদ্ধের নয় মাস জোহরের সঙ্গে কলিমুল্লাহর একধরনের যোগাযোগ থাকে। কলিমুল্লাহর অন্যায়-অপকর্ম ভণ্ডামি দেখতে দেখতে জোহর বিরক্ত। একবার কথা প্রসঙ্গে পাকিস্তানি গোয়েন্দা হয়েও জোহর কলিমুল্লাহকে বলে, তার দোজখে যেতেও আপত্তি নেই। আপত্তি কলিমুল্লাহর মতো লোক সেখানে থাকবে। এই কলিমুল্লাহরা মীর জাফরদের লজ্জা দিয়েছে। এই কলিমুল্লাহ যুদ্ধ শেষে দাড়ি-মোচ কেটে ভালো হওয়ার চেষ্টা করে।

কিছু বিষয়ে উপন্যাসের লেখক হুমায়ূন আহমেদ মন খারাপ করেছেন। দেশের নিয়মিত বাহিনীর সঙ্গে সাধারণ মানুষ যুদ্ধ করেছে। তাদের অনেকের বিস্ময়কর শক্তি, সাহস ও বীরত্বে অনেক জনপদের জীবন রক্ষা পেয়েছে। কখনো নিশ্চিত মৃত্যুর মুখ থেকে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের জন্য বেঁচে গেছেন। ‘জোছনা ও জননীর গল্পে’ রফিক, কায়েস এমন মুক্তিযোদ্ধা।

কিন্তু রাষ্ট্রের কাছ থেকে ন্যূনতম সম্মানটুকু তারা পাননি। আবার অনেকে ভারতীয় বাহিনীর অবদানকে ছোট করে দেখে। তাদের যত সৈন্য মারা গেছে, সেটার এক বিশাল তালিকা হবে। কারও আবদান অস্বীকারের মধ্যে কোনো মহত্ত্ব নেই। তারা না থাকলে এ দেশের বিজয় কত দীর্ঘ হতো, আমরা জানি না।

অনন্তকাল পরও মানুষ এ উপন্যাসটি মনে রাখবে মনে হয়। উপন্যাসটিতে আছে পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতা। রাজাকারদের বর্বরতা। জ্বালাও পোড়াও, হত্যা, লুটপাট। একই সঙ্গে এ দেশের নিয়মিত ও সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের বিস্ময়কর বীরত্ব। আত্মত্যাগ। আবার আসলাম খার মতো মানুষ, যারা বিহারি, পাকিস্তানি হয়েও সহযোগিতা করেছে। সবার বীরত্ব ও আত্মত্যাগের জন্যই মাত্র ৯ মাসে স্বাধীনতা পেয়েছি।

যুদ্ধ থেকে ফিরে আসতে পারেননি নাঈমুলের মতো হাজারও মুক্তিযোদ্ধা। মরিয়মের মতো নববধূরা তাদের প্রাণের মানুষ ফিরে পাননি আর কোনো দিন। নাঈমুল না ফেরা মুক্তিযোদ্ধা স্বামীদের প্রতীকী। মরিয়ম স্বামীহারা নারীদের প্রতীকী।

নারী, শিশু, বৃদ্ধ সব শ্রেণির মানুষের এক অমানবিক জীবনের উপাখ্যান এ উপন্যাস। বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে এর থেকে বেদনার বছর আর ছিল না। এ বেদনার প্রায় সবটুকু একাকার হয়ে আছে ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ উপন্যাসে। সময়ের সঙ্গে এটি হয়তো একটি কালজয়ী উপন্যাসে পরিণত হবে।

লেখক: সাংবাদিক ও সংগঠক