শিশিরভেজা সকালের স্নিগ্ধ রোদের মিষ্টি পরশ গাছগাছালির পাতার ফাঁক গলে এসে আমার শরীর ছুঁয়ে দিয়ে জানান দিচ্ছে তার আগমন। খালি পায়ে সবুজ দুর্বাদল মারিয়ে সকালের সৌন্দর্য অবলোকনের সাথে আরেক মায়ার সাগরের শব্দের বাণে জর্জরিত হওয়ার জন্য হেঁটে যাচ্ছি নদীর পাড়ের দিকে। ধুলাবালিতে ভরা ময়লা শহর থেকে ক্লান্ত শরীর নিয়ে শান্তির নীড়ে ফিরে এসেছি দীর্ঘ এক বছর পর। গ্রামীণ আবহাওয়ায় শীতের আবির্ভাব নতুন রূপে মনের সতেজতাকে যেন বহুগুণে বাড়িয়ে দিচ্ছে।
নদীর পাড়ের দিকে যাচ্ছি রহমান ভাইয়ের বাড়ির উদ্দেশে। রহমান ভাইয়ের মেয়ে জুঁই। সেই যে গতবার ঢাকা গেলাম, আমার ছাত্রী ছিল সে। ক্লাস ফোরে পড়ত তখন মেয়েটা। অসম্ভব বুদ্ধি ওর পড়াশোনায়। ওই বয়সেই অনেক কিছুই শেখার ক্ষমতা ছিল ওর। আর আমিও সন্তুষ্ট শিক্ষকের ন্যায় ওকে পড়িয়ে যেতাম।
ছিপছিপে গড়নের মেয়েটির মায়া আমি আজও কাটাতে পারিনি। সে যখন মুখে আলত হাসি নিয়ে কাকু বলে ডাকত, তখন আমার সদা সদয় মনে তার শব্দ-তরঙ্গের দোলা লাগত।
জুঁই একটা আবদার করেছিল গতবার ঢাকা যাওয়ায় সময়। যাওয়ার দিন বলেছিল,
—কাকু, আমার জন্য গল্পের বই আর চকলেট নিয়ে আসবা কিন্তু এরপর আসার সময়।
বাচ্চাদের পবিত্র মন হতে নির্গত মোলায়েম চাওয়া পূরণ করতে যে আমি সব সময়ই আপ্রাণ চেষ্টা করে যাই। আমিও ওর মাথায় হাত দিয়ে বলেছিলাম,
—আচ্ছা মা, আনব তোমার জন্য। তুমি ঠিকমতো পড়াশুনা করো, কেমন?
সে মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতিসূচক হ্যাঁ বলেছিল।
আজও ওই মুখটা ভীষণভাবে মনে পড়ে। মনে মনে বললাম,
—মেয়েটা নিশ্চয় আজ অনেক খুশি হবে ওর পছন্দের জিনিস হাতে পেয়ে।
সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই জুঁইদের বাড়ির উঠানে এসে পড়েছি। বাড়িঘরের চেহারায় কেমন যেন একটা ছন্নছাড়া ভাব বিদ্যমান। মনে হচ্ছে বড়ই অযত্নে লালিত হচ্ছে চারদিক। ভিতরে প্রবেশ করে ডাক দিলাম,
—জুঁই...।
—জুঁই.... কই মা তুমি? এই দেখো, এসে গেছি আমি।
জুঁইয়ের মা নয়ন ভাবি বেরিয়ে এল ঘর থেকে। ভাবিকে দেখেই বললাম,
—ভাবি, ভালো আছেন?
জুঁই কোথায়?
—ওই মোড়াটায় বসো।
মোড়ায় বসে গল্পের বই আর চকলেটের প্যাকেটটা নামিয়ে রাখলাম পাশের অন্য একটি মোড়ার ওপর। খেয়াল করলাম, ভাবির শরীরেও কেমন যেন অযত্নের প্রভাব। চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে খুঁটির সাথে হেলান দিয়ে। বললাম,
—ভাবি.... জুঁই বাড়িতে নেই নাকি? থাকলে তো এতক্ষণে এসে আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ত।
—তোমার জুঁই আর ঝাঁপাবে না মাস্টার।
—কেন? ওর মামাবাড়িতে গেছে নাকি?
—সে যে আমাদের সবাইকে ছেড়ে চলে গেছে মাস্টার!
কথা শেষ না হতেই মায়ের আত্মা সন্তান হারানোর শোকে দিগবিদিকশূন্য হয়ে কান্না নামক সাগরে নিমজ্জিত হলো। আর আমিও এই কথা শুনে অনুভব করলাম, কী যেন একটা বুকের ভিতরে মোচড় দিয়ে উঠতে লাগল আর আমি স্তব্ধ হয়ে সেই কথাগুলো শুনতে লাগলাম।
—এই গত শুক্রবারে জুঁই নদীর জলে পড়ে গেছিল। অনেক খোঁজাখুঁজি করে বিকেলে ওর লাশ নদীর জলে ভেসে উঠল।
কান্নার বাঁধ ভেঙে পড়ে আমাকে সেই জলে যেন ডুবিয়ে নিয়ে গেল অজানা জল থেকে জলের গভীরে। আর সেই কান্নার জলে আমি খড়কুটোর ন্যায় হাবুডুবু খেতে লাগলাম। আমার আর শক্তি রইল না জুঁইয়ের মাকে সান্ত্বনা দেওয়ার। আমারই যে সান্ত্বনার প্রয়োজন। কে দেবে আমায় সান্ত্বনা? দগ্ধ মনে হাহাকারের গভীর নিশ্বাস নিয়ে বেরিয়ে এলাম নিস্তব্ধতার বাড়ি থেকে।
আমার এই স্বল্প পরিসরের জীবনে জুঁই যে কতখানি জায়গা দখল করে আছে, তা তো শুধু আমার অন্তরাত্মাই জানে। ওর মুখের কাকু ডাকের প্রশান্তির ঝড়ে যে বহুবার হারিয়ে গিয়েছি দূর থেকে দূরান্তে। ঠিক করেছিলাম ভবিষ্যতে ওর পড়াশোনার দায়িত্ব আমিই কিন্তু আজ আমার মনের মাঝে লালিত এই স্বপ্নটা ভেঙে খানখান হয়ে দীর্ঘশ্বাস দিয়ে বেরিয়ে গেল।
পথের ধারেই সদ্য মাটিচাপা দেওয়া একটা কবর দেখে আর বুঝার বাকি রইল না যে এখানেই আমার প্রিয় ভাইঝি জুঁই পরম নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে। আজ কত্ত শান্তি ওর! ওকে আর অঙ্ক করতে হবে না! না হবে ইংরেজি পড়তে! আমার সঙ্গেও আর বকবক করবে না! আর আমিও বলব না,
—জুঁই, এখন পড়াশোনা করো মন দিয়ে।
আজ সকল শান্তিরা যেন ওকে ছেয়ে আছে অতন্দ্র প্রহরীর ন্যায়।
কবরের পাশে দণ্ডায়মান জবাগাছটি থেকে লাল টকটকে তিনটা রক্তজবা ছিঁড়ে নিয়ে কবরের পাশে তাকিয়ে রইলাম। মেয়েটা যে বড্ড ভালোবাসতো জবা ফুল আর তিন সংখ্যাটাও যে ওর ভীষণ প্রিয়
—‘তোমার কাকু কি আর দিবে তোমায় মা! এইটাই নিও।’
আর দাঁড়াতে পারলাম না আমি। বুকের ওপর কে যেন পাথরচাপা দিয়েছে। আর কান্নার ঢেউ প্রবল বেগে বারবার আঘাত করতেছে মনের সমুদ্রের তীরে। প্রতি ধাক্কা ভেঙে নিয়ে যাচ্ছে অংশের পর অংশ।
ফুলগুলো ওর মুখের কাছে নামিয়ে দিতে গিয়ে গনগনে আগুনে পোড়া মন তারই অজান্তে তিন ফোঁটা চোখের জলও নামায়ে দিল উপহারস্বরূপ। বললাম বিড়বিড় করে, অংশ।
এমন সময় খিলখিলিয়ে হেসে, বাতাসকে ছাপিয়ে পরিচিত সুমধুর কণ্ঠে ডেকে উঠল,
কাকু...।