ছড়ানো–ছিটানো সংসার

প্রতীকী ছবি
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

বাইরে বৃষ্টি। জানালায় মুখ রেখে তাকিয়ে ছিলাম। ট্রেন থামল স্টেশনে। যাত্রীদের গিজগিজ, ব্যাগ–বস্তার টানাটানি, কুলি আর হকারের চিৎকার। এরই ফাঁকে দেখি প্ল্যাটফর্মে তিনজন ভিক্ষুক—স্বামী, স্ত্রী ও সন্তান। লোকটার একটা পা হাঁটু অবধি কাটা, দাঁড়িয়েছে ক্রাচে ভর করে। হাতে ভিক্ষার থালা, পাশে তার বউ। মায়ের কোলের শিশুটি হাত উঁচিয়ে মা–বাবার ওপর ছাতা মেলে রেখেছে। টুংটাং শব্দে থালাতে কিছু পয়সা ছুড়ে মারলাম। অমনি কী আনন্দ শিশুটার। দম্পতির মুখেও তৃপ্তির হাসি। একটা ছাতার নিচে একটা সংসার, কত পরিপাটি।

সংসার আছে আমারও। ছড়ানো–ছিটানো সংসার। সকাল আটটায় নাকে–মুখে দুমুঠো দিয়ে কর্মস্থলে ছুটি। সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে বাঁধি গলার টাই। মিম, মানে আমার বউ, তার নয়টা–পাঁচটা অফিস। ড্রেসিং টেবিলে ব্যস্ত হাতে চুল আঁচড়ানোর বেলায় গলাবাজি করে, ঘরদোর সামলে কোনো দিন ঠিক টাইমে অফিসে যেতে পারল না। রাতে বিছানায় উল্টো পাশ ফিরে শোয়। গায়ে হাত বুলিয়ে অভিমান ভাঙাতে যাই যখন, খেঁকিয়ে ওঠে। আমাদের একমাত্র মেয়ে, সুহা যার ডাকনাম। একলা ঘরে টিভি দেখতে দেখতে চোখে জ্বালা ধরে গেলে জানালার গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে আকাশ দেখে। মেঘেদের দিকে তাকিয়ে নিজের পুতুলটার সঙ্গে কথা কয়, কোলে নিয়ে বসে থাকে।

ট্রেনের হুইসেলে সংবিৎ ফিরল। টিকিটের সঙ্গে নম্বর মিলিয়ে দুজন যাত্রী বসেছে সামনের সিটটায়। বৃদ্ধ মা আর পুত্র। ছেলেটার হাতে এক্স–রে প্লেট, প্রেসক্রিপশন, ওষুধপত্রের পুটলি। বৃদ্ধার ডান হাতে কনুই অবধি ব্যান্ডেজ, গলাতে ঝোলানো। সম্ভবত ডাক্তারখানা থেকে ফিরছে। মনে পড়ল, আমার মায়ের হার্ট অ্যাটাকের দিনগুলোতে হাসপাতালেই যেতে পারিনি। আম্মার অসুখ, গ্রামে যাব। বউয়ের অভিমত নিতে গেলে জানাল, ‘তোমার অন্য ভাইরা কেন আছে? বাবা কী করেন! তোমার না অফিসে কাজের চাপ?’

ট্রেন ছুটছে তীব্র, বাতাসে উড়ছে চুল। আমি জানি, উঠানে পা রাখতেই মা আমাকে দূর থেকে দেখে শোয়া থেকে তড়িঘড়ি উঠে বসবেন। প্যারালাইজড পা দুটি নিয়েই বিছানা ফেলে উঠে আসার ব্যর্থ চেষ্টা করবেন। কেমন আছি জিজ্ঞাসার পরপরই বলবেন, ‘বউমাকে দেখছি না কেন? নাতনিটাকে নিয়ে এলে কী হতো?’ কাঁধের ভারী ব্যাগটা মেঝেতে রেখে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ব যখন, তসবিহ জপা থামিয়ে বাবা বলবেন, ‘আর কত শহরে থাকবি! তোদের ছাড়া বাড়িঘর কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে...।’