চলে এলাম দ্বিতীয়বারের মতো

ছবি: রয়টার্স

২৫ জানুয়ারি ২০২০। রাত ১১টা ৪৫ মিনিটের সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনসের বিমানে করে সিঙ্গাপুরে ফিরব। রাত ৯টায় আমাকে এয়ারপোর্টে ড্রপ করতে এল মামুন ভাই। সিঙ্গাপুরিয়ান বন্ধুদের মিষ্টি খাওয়ানোর কথা দেওয়া ছিল আমার, সে জন্য সন্ধ্যায় উত্তরা থেকে মিষ্টি কিনতে কিনতে মামুন ভাইকে জিজ্ঞেস করছিলাম, ‘ভাই আজকে না দেরিই হয়ে যায়! উত্তরায় এ সময় যা জ্যাম থাকে!!’

ভাই বলল, ‘দেরি হবে না ইনশা আল্লাহ।’

খুব দ্রুত পৌঁছে গেলাম এয়ারপোর্ট। মামুন ভাই আমার জন্য গত কয়েক দিন যা কষ্ট করেছে, আমি যা বিরক্ত করেছি সেটা বলার মতো নয়। তবুও ভাই তো, বিনিময়ে ভালোবাসাই দিয়েছে শুধু। ভাইয়ের প্রতি আমার ভালোবাসাও সব সময় বেশি। বিদায়বেলায় মামুন ভাইকে বুকে জড়িয়ে বিদায় জানানোর সময় চোখে পানি চলে এল।

আজও এই লেখা লেখার সময় আমি ওনাকে খুব মিস করছি।

ঢাকা এয়ারপোর্টের ভিতর ঢুকে এবার মাথা গোলমেলে হয়ে গেল। দুই হাতে দুই লাগেজ, কাঁধে ঝোলানো ব্যাকপ্যাক, খুঁজছি সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনসের কাউন্টার, কিন্তু যেন খুঁজে পাই না। নেই কোনো সাইনেজ। ডিসপ্লেতে কিছুক্ষণ চোখ বোলানোর পর খুঁজে পেলাম।

কাউন্টার থেকে মাথা গুনতে গুনতে দেখলাম প্রায় ৭০-৮০ জনে গিয়ে লাইন শেষ হয়েছে। দ্রুত লাইনের শেষে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমি দাঁড়াতে দাঁড়াতেই আরও ৫-৬ জন এসে পেছনে দাঁড়াল। বোর্ডিং কাউন্টারগুলোর সামনে সে কি চেঁচামেচি! ব্যাগ নিয়ে টানাটানি! বাচ্চাকাচ্চার কান্না! কী এক ভয়াবহ অবস্থা এয়ারপোর্টে। এসব দেখে এক মিনিটও অপেক্ষা করতে মন চাচ্ছিল না। কিন্তু উপায় কি! লাইন তো এগোচ্ছে লোকাল ট্রেনের মতো। এক ঘণ্টার বেশি সময় লাগল কাউন্টার পর্যন্ত পৌঁছাতে। সেখান থেকে বোর্ডিং পাস নিয়ে নিলাম। এর মধ্যে কাউন্টারের প্রায় কাছাকাছি এসে দুজন মানুষের সাথে পরিচয় হলো। ষাটোর্ধ্ব হবে। স্বামী-স্ত্রী দুজনে মিলে কোনো এক দেশে যাচ্ছেন, সিঙ্গাপুরে তাদের ট্রানজিট। আমাকে কিছু বলতে চাচ্ছিলেন, বুঝে আমি সালাম নিয়ে এগিয়ে গেলাম। আমাকে ডেকে বললেন, ‘বাবা তুমি একা! আমাদের একটা কাজ করে দাও না!’ তাঁদের ডিপারচার কার্ড লিখে দিতে বললেন। তারপর পরিচয় হলো। আমি কী করি, কোথায় থাকি, দেশের বাড়ি কোথায়, পরিবার—সবকিছু নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন। কত আন্তরিক আমাদের দেশের মানুষ, ভাবতেই অবাক লাগে!

বোর্ডিং পাস হাতে নিয়ে ইমিগ্রেশনের লাইনে দাঁড়িয়ে পরলাম, সেখানে আরেক বিড়ম্বনা। ইমিগ্রেশন অফিসাররা তাঁদের দায়িত্ব আদান-প্রদানে প্রয়োজনের চেয়ে বেশিই সময় নিয়ে নিলেন।

যা–ই হোক, পাসপোর্ট, বোর্ডিং কার্ড, আরও কিছু কাগজপত্র চেক করলেন। থাম্ব প্রিন্ট, ফেস স্ক্যানিং করে সব মিলিয়ে ৩-৪ মিনিট সময় লাগল অফিসারের কাজ শেষ হতে। শুধু ইমিগ্রেশন কাউন্টার পার হতে ৪০ মিনিট লেগে গেল। আমার হাতে তো ঘড়ি। সময় গুনছি রেগুলার। ওয়েটিং লাউঞ্জে বসে আছি। কত কিছু মনে পড়ছে। পরিবার-পরিজন, প্রিয় মাতৃভূমি ছেড়ে আবারও চলে যাচ্ছি। খারাপ লাগছে। আবেগাপ্লুত হচ্ছি। আব্বু–আম্মুসহ কাছের কয়েকজনের সাথে ফোনে কথা বললাম। এরপর অন-বোর্ড করার ডাক পড়ল। সিকিউরিটি চেক করে ওয়েটিং রুমে বসলাম। ভীষণ একা লাগছে। এত অল্প দিনের ছুটিতে এলাম। অনেক প্রিয় মানুষ, বন্ধুর সাথে কথা দিয়েও দেখা করতে পারিনি। একটা ক্ষোভ কাজ করছিল। অনেক কষ্টের স্মৃতিও মনে হচ্ছে। কত মানুষ বদলে গেছে!

কিছুক্ষণ পর বিমানে বোর্ডিং করলাম। বসে আছি । খুব সুন্দর পরিবেশ এয়ারক্রাফটের ভেতরে। মাঝের সারির চার সিটের দ্বিতীয় সিট আমার। বসে পড়লাম। হালকা ঠান্ডাও আছে ভেতরে। যদিও সে সময় ফ্লাইট স্টুয়ার্ডরা সব সিটে কম্বল দিয়ে দিয়েছিল। কিছু সময় পর বিমানযাত্রা শুরু হলো। আমার ভালো লাগাও শুরু হলো। এ যেন আমি আমার আরেক জীবনে ফিরে যাচ্ছি। এক স্বাধীন জীবনে।

ফ্লাইটে এন্টারটেইনমেন্টের যথেষ্ট ব্যবস্থা ছিল। স্টার্টারে নাটস, কুকিজ দিয়ে দিল, সেগুলো চাবাতে চাবাতে ডিসপ্লেতে গান, সিনেমা দেখছিলাম। মাঝেমধ্যে ফ্লাইট ট্র্যাকারে বিমানের অবস্থান চেক করছিলাম।

ভোর সাড়ে ৫টা বা ৫টা ৪০–এ চাঙ্গি ল্যান্ড করল বিমান। এখানকার নাগরিক ও লং টার্ম হোল্ডারদের জন্য আলাদা লাইন। ইমিগ্রেশন করতে সময় লাগে কয়েক সেকেন্ড। শুধু পাসপোর্টের মূল পেজ স্ক্যান করে, ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিলেই দরজা স্বয়ংক্রিয়ভাবে খুলে যায়।

ইমিগ্রেশন শেষ করে বেল্ট পর্যন্ত আসার আগেই ল্যাগেজ বেল্টে পৌঁছে যায়। আমি আমার ব্যাগপত্র সব বুঝে নিয়ে এমআরটি (ট্রেন) স্টেশনের দিকে যাচ্ছি, টার্মিনাল ২ আর ৩–এর ঠিক মাঝামাঝি জায়গায় বেজমেন্টে এমআরটি স্টেশনের অবস্থান। দুই হাতে দুই লাগেজ, হাতের ভাঁজে পরনের ব্লেজার, স্যুট, মিষ্টির প্যাকেট, কাঁধে আরেক ব্যাগ নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে নির্ঘুম নাজেহাল আমি। ট্যাক্সি নেব ভাবতেই মনে পড়ল ডলার চেক করার কথা। মানিব্যাগ খুঁজে কোনো ডলারের হদিস পেলাম না! সাইড ব্যাগেও চেক করলাম। এরপর আবিষ্কার করলাম আমার কাছে সে সময় কোনো ডলার নেই!

কী একটা অবস্থা! খুঁজতে খুঁজতে সাইড ব্যাগের সবচেয়ে ভেতরে চেইন খুলে সব মিলিয়ে ৩ ডলার কয়েক সেন্ট পেলাম। সেই পরিমাণ অর্থ দিয়ে আমি বাড়ি পৌঁছাতে পারব না, সেটাও নিশ্চিত হলাম।

ভোর ছয়টায় তো কাউকে ফোন করতেও পারব না।

মাথা কাজ করছিল না।

এর মধ্যে মনে পড়ল যে আমার ব্যাংকে তো টাকা আছে, কিন্তু কার্ড তো দেশে হারিয়ে এলাম। কার্ড ছাড়া টাকা তোলারও কোনো উপায় নেই। সাথে থাকা এমআরটি কার্ড (পাবলিক ট্রান্সপোর্টে যাতায়াতের জন্য পূর্ব-পরিশোধিত কার্ড) চেক করে দেখলাম মাত্র ১ ডলার কয়েক সেন্ট আছে। তো সেটাও ব্যবহারের কোনো সুযোগ নাই।

তবে মানিব্যাগে হাজার দুই–তিনেক টাকা ছিল। সেটা এক্সচেঞ্জ করা ছাড়া আর কোনো বুদ্ধি নাই।

বাধ্য হয়ে ক্যাশ যা ছিল সব গুছিয়ে ফেরার পার্ক পর্যন্ত ট্রেনের টিকিট কিনলাম। এমআরটি থেকে নেমে মোস্তফা মানি এক্সচেঞ্জের দিকে হাঁটতেই বুঝলাম লাগেজের এক হুইল ভাঙা ভাঙা অবস্থা! এভাবেই টানতে টানতে মানি এক্সচেঞ্জে গিয়ে পৌঁছালাম। টাকা চেঞ্জ করে। ঢাকা রেস্টুরেন্টে গেলাম সকালের নাশতা করতে। ঘড়িতে তখন সময় সকাল আটটা। নাশতা সেরে ট্যাক্সি নিয়ে বাসায় গিয়ে পৌঁছালাম।

বাসায় ফ্রেশ হয়ে একটু রেস্ট করতেই ফোন এল। সেদিন যে আমার বন্ধু কারি আমাকে চাইনিজ নিউ ইয়ারের লাঞ্চের আমন্ত্রণ করেছিল সেটাও ভুলে গেছি।

রেডি হয়ে মিষ্টির প্যাকেট হাতে দৌড় দিলাম।

তানজং পাগারে দৌড়াতে দৌড়াতে গিয়ে পৌঁছালাম। বন্ধুদের সাথে দেখা হলো, নতুন কারও কারও সাথে পরিচয়ও হলো।

এরপর দেশি-বিদেশি সবাই মিলে মিষ্টি খাওয়ার পর্ব শেষ করল। সবাই মিষ্টির প্রশংসা করল। খাওয়াদাওয়া শেষ করে নাজমুল ভাইয়ের নেতৃত্বে বেরিয়ে পড়লাম শহর ঘুরতে। পিনাকল, তানজং পাগার, চায়না টাউনের এখানে ওখানে ঘুরতে ঘুরতে প্রায় বিকেল হয়ে গেল। সেখান থেকে নাজমুল ভাইয়ের সাথে ট্যাম্পানিজ গেলাম। সেখানে রাতে পরিবারের সবার সাথে খাবার খেয়ে আমি আমার গন্তব্যে পৌঁছালাম। দেশ থেকে ফিরে আরও কিছু স্মৃতি জমিয়ে ঘরে ফিরলাম।