খেজুরের রস চুরি

প্রতীকী ফাইল ছবি

গল্পটা এক যুগ আগের। তখন আমরা নিউ টেনে পড়ি। দল বেঁধে স্কুলে যাই, হই-হুল্লোড় করি। বুদ্ধিটুদ্ধি খাটিয়ে এটা-ওটা চুরি করি। ধরা পড়ি পড়ি করেও কৌশলে বেঁচে যাই। সেই বছর শীতও বেশ জেঁকে বসেছিল। কনকনে শীত। হিম হিম বাতাসের মৃদু চুম্বনে হাড়ের ভেতরও কাঁপন ধরে যেত! ঠকঠক করে কাঁপত দাঁতের পাটি ও পা। তেমনি এক শীতের রাতে আমাদের পাশের গ্রামে মানিক ফকিরের ওরস হচ্ছিল। সে এক এলাহি কাণ্ড। রঙিন কাপড়ের বিশাল প্যান্ডেল। লাল-নীল মরিচবাতির আলোর ঝলকানি। গমগম করা মানুষের সমাগম। গরু-ছাগলের হাম্বা হাম্বা-ভ্যাঁ ভ্যাঁ ডাক। হাঁড়ি-পাতিলের ঝনঝনে শব্দ। কয়েকটা গ্রুপে ভাগ হয়ে মানিক ফকিরের আশেকান মুরিদানরা আসর বসিয়েছে। হারমোনিয়াম ও ঢোল করতাল দিয়ে গান গাইছে। মারফতি সব গান। আধ্যাত্মিক গানও আছে। এই সব গানটান শুনতে আমাদের ভালো লাগছিল না।

আমরা ৬-৭ জন বন্ধু মিলে গিয়েছিলাম ওরস দেখতে। মূলত শহর থেকে আসা মেয়েদের দেখার জন্য গিয়েছিলাম সেখানে। মেয়েগুলো দেখতে ঠিক পুতুলের মতো। কেউ কেউ তো ডানাকাটা পরির মতো সুন্দর! পেটচুক্তি শিন্নি খাওয়ার পর হঠাৎ আমাদের বুদ্ধিজীবী বন্ধু বিটুলের মাথায় একটা কুবুদ্ধি এল। রস চুরির কুবুদ্ধি। মনির জোয়ার্দারের পুকুরপাড়ে তিনটা খেজুরের গাছ আছে। সেখানে দুটি গাছে এবার কলস বেঁধেছে। আগে আমাদের গ্রামে অনেক খেজুরগাছ ছিল। এখন নাই বললেই চলে। বিটুলের মতে, আজ রস চুরি করা খুব সহজ হবে। চুরি করা রস খেজুরগাছের নিচে বসে খাওয়ার মধ্যে একটা তৃপ্তির ব্যাপার আছে! ভাবসাব আছে।

আগে থেকেই জানা ছিল, মনির জোয়ার্দার ওরসে থাকবেন। এসব ব্যাপারে তার ঝোঁক অনেক। তাই ধরা পড়ার চান্স নাই বললেই চলে। বিড়াল পায়ে আমরা সদল জোয়ার্দার বাড়ির পুকুরপাড়ে গিয়ে হাজির হলাম। আশপাশে খুব ভালো করে তাকিয়ে দেখে নিলাম এখনো কেউ সজাগ আছে কি না? চারদিকে সুনসান নীরবতা। চুরি করতে এসে বেশি দেরি করতে নেই। তাই বিটুল কয়েক লাফে খেজুরগাছের মাথায় ওঠে গেল। কলস চেক করে বিটুল খুব খুশি। বিটুলের খুশির লেবেল দেখে বোঝা যাচ্ছে, কলসে ভালোই রস জমেছে। আমরাও তার খুশিতে দারুণ খুশি। মাটির কলসে রশি বেঁধে ওপর থেকে নিচের দিকে চালান করছে বিটুল। ঠিক তখনই ঘটল বিপত্তিটা! জোয়ার্দার বাড়ির কুকুর ভুলু সেদিন খুব খেপেছে। ঘেউ ঘেউ করতে করতে বিটুলদের দিকে এগিয়ে আসছে। কুচকুচে কালো ভুলুকে দেখে গাছের নিচে দাঁড়ানো নিশিকুটুমরা দল বেঁধে দৌড়ে পালিয়ে গেল। বিটুল খেজুরগাছ থেকে সবকিছু দেখছে। তার মনে পড়ে গেল কোথায় যেন পড়েছিল, বিপদেই বন্ধু চেনা যায়। সে এক হাতে কলসে বাঁধা দড়ি এবং আরেক হাতে খেজুরগাছের ডাল ধরে আছে। দৈত্যের মতো ভুলু তখনো দাঁত ভেংচিয়ে ঘেউ ঘেউ করছিল। বিটুল খুব সাহসী ছেলে হলেও আজ বেশ ভড়কে গেছে! তাই সে খিঁচ মেরে গাছেই ঝুলেছিল। নিচে নামলে ভুলু কামড় দিতে পারে। আর কুকুর কামড় দিলে নাভিতে ১৭টা ইনজেকশন নাকি নিতে হয়। তাই সে চুপচাপ গাছে দাঁড়িয়ে আছে।

ওই দিকে মানিক ফকিরের ওরসের মাইকে কে যেন ঘোষণা করছে যে দক্ষিণ পাড়ার জোয়ার্দার বাড়িতে চোর ঢুকেছে। ঘোষণা শোনামাত্রই ওরসের শত শত মানুষ দিল ছুট। কারও কারও হাতে টর্চলাইট জ্বলছে। দূর থেকে টর্চলাইটের আলোকে জোনাকি পোকার মতো মনে হচ্ছে। ঘটনা সুবিধাজনক নয়, তাই গাছ থেকে নেমে আসার সিদ্ধান্ত নেয় বিটুল। কিন্তু ভুলুর ভয়ে নিচে আসতেও পারছে না। তাই সে সিদ্ধান্ত নিল খেজুরগাছ থেকে সে লাফ দিয়ে পুকুরে পড়বে!

শীতের রাত। কনকনে হিমেল বাতাসে এই পুকুরের বরফজলে লাফ দেওয়া চাট্টিখানি কথা না। ঠান্ডায় জমে আসতে পারে তার শরীর। শরীরে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যেতে পারে। বিটুল সরিষাখেতের দিকে তাকিয়ে দেখে, মানিক ফকিরের শত শত আশেকান তার দিকে ছুটে আসছে। উপায়ন্তর না পেয়ে বিটুল পুকুরের বরফ শীতল জলে লাফ দেয়। কোনো রকমে সাঁতরে উত্তরের তীরে ওঠেই সে ভোঁ দৌড়।

চারদিকে চোর চোর ধ্বনি। মানুষের হাঁকডাক। এই দিকে প্রাণপণে দৌড়াতে থাকে বিটুল। আর আনমনে বলতে থাকে, ওই চোর চোর চোর!