ক্যারিয়ার বলতে কী বুঝব
ছোটবেলায় ‘ক্যারিয়ার’ বলতে সাইকেলের ‘ক্যারিয়ার’ বুঝতাম। আমাদেরটা ‘ক্যারিয়ার’ ছিল না। বাবার একটা ‘হারকিউলিস’ সাইকেল ছিল, বেশ পুরোনো। সেটাতে কোনো ‘ক্যারিয়ার’ দেখিনি। কিন্তু বেশ চলত। আর একটু পরে ‘ক্যারিয়ার’ বলতে শিখলাম ‘টিফিন ক্যারিয়ার’। এখন ‘ক্যারিয়ার’ বলতে তরুণেরা বোঝে ‘কর্ম ও প্রতিষ্ঠা’। অর্থে বেশ পাল্টেছে শব্দটা! পাল্টাবেই তো। যুগ পাল্টেছে না?
আমাদের তরুণ বয়সে দেশে স্বৈরশাসক এরশাদবিরোধী আন্দোলন চলছিল। আমি ১৬ বছর বয়সেই সেটাতে যুক্ত হয়ে পড়েছিলাম। বিজ্ঞানের ছাত্র। স্কুলে প্রথমই হয়েছি, দু-একবার দ্বিতীয়। কিন্তু আমার মনে হলো, এরশাদকে না তাড়ালে লেখাপড়ার কোনো দাম নেই। আমি নেমে পড়েছিলাম কোমর বেঁধে। মা-বাবাসহ আদর করতেন যাঁরা, সবাই চাইতেন যেন ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হই। কিন্তু আগে থেকেই আমার ঝোঁক চেপেছিল সাহিত্যের লেখাপড়ায়। উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে যখন বাংলা সাহিত্যে স্নাতক (সম্মান) শ্রেণিতে ভর্তি হই, আদর যাঁরা করতেন, তখন সবাই হতাশ। মা-বাবা তো প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ ছিলেন। আমি ফলিত রসায়নে ভর্তির সুযোগ পেয়েছিলাম। পড়িনি। আজ ভাবি, কী হতো পড়লে? এর চেয়ে কি ভালো হতো? আমার বিশ্বাস হয় না। কারণ, আমার ভালোবাসায় ‘রসায়ন’ ছিল না, ছিল ‘বাংলা’! ভালোবাসার জন্য আমি ফলিত রসায়ন রেখে বাংলা নিয়ে বাজিতে নেমেছিলাম।
অনেকেই তো ভালোবাসার জন্য বাজি ধরেছেন। কেউ একটু আগে, কেউ একটু পরে। আনিসুল হক বুয়েট থেকে পাস করা প্রকৌশলী। তিনি বাজারে চাকরি করলে অর্থবিত্ত অনেক আগেই তাকে ঢেকে দিত। তিনি কিন্তু আর দশজনের মতো দশটা-পাঁচটার চাকরি করলেন না। ছাত্রজীবন থেকেই লেখালেখি করতেন। এলেন সাংবাদিকতায়। বারবার চ্যালেঞ্জ নিতে দেখেছি তাকে। অন্তত চারটা পত্রিকার আত্মপ্রকাশের সঙ্গে তিনি কর্মজীবনকে জড়িয়ে দিয়েছিলেন। প্রতিষ্ঠার চ্যালেঞ্জ যে কী ছিল, দূর থেকে হলেও আমি জানি; আমার বয়সী যারা, তারা জানেন। যেকোনো একটিতে ফসকে যেতে পারতেন! সেই চ্যালেঞ্জ কিন্তু তিনি নিয়েছিলেন ভালোবাসার জোরে। তিনি প্রকৌশলী বটে, তবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন সাহিত্যিক আর সাংবাদিক হিসেবে। দেশে আনিসুল হক নামে কতজনই তো আছেন। কিন্তু আনিসুল হক একজনই। তাহলে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হওয়াও কি ‘ক্যারিয়ার’? আজতো সাকিবকে সারা বিশ্বের মানুষ চেনে আবার সেঁজুতি সাহাকেও। তাই আজ পৃথিবীতে ‘ক্যারিয়ার’ শুধুই একটি বা দুটি বিষয়ে আটকে নেই।
ইংরেজি ‘ক্যারিয়ার’ শব্দটির শুরুতেই আছে ‘কেয়ার’। ‘কেয়ার’ হলো মনোযোগ বা ‘অ্যাটেনশান’। তো নিজের প্রতি, নিজের ভালো লাগার প্রতি ‘কেয়ার’ বা ‘অ্যাটেনশান’ না দিয়ে বাজারি ‘ক্যারিয়ার’-এর ইঁদুর দৌড়ে ঝাঁপ দিলে হবে? ‘অক্সফোর্ড’ অভিধানে ‘ক্যারিয়ার’ বলতে তিনটি অর্থ বুঝিয়েছে:
প্রথমটি, কোনো মানুষের বহু চাকরির ধারাবাহিকতা;
দ্বিতীয়টি, জীবনে কোনো নির্দিষ্ট কাজে যুক্ত থাকার সময়-পরিধি;
তৃতীয়টি, অনিয়ন্ত্রিত পথে দ্রুত, স্বচ্ছন্দ আর বিশেষভাবে অগ্রগমন।
এর মধ্যে তৃতীয় অর্থটিই কিন্তু ‘কেয়ার’ বা ‘অ্যাটেনশান’-এর সঙ্গে যুক্ত। কারণ, মানুষের সামনের দিনগুলো তো তার জানা নেই, নিয়ন্ত্রণেও নেই। সেই পথে মানুষ তার জীবনটি যদি সে দ্রুত অথচ ছন্দময় করে বিশেষভাবে অগ্রগমন মানে এগিয়ে নিতে পারে, সেটাই তো সুখের, সেটাই তো আনন্দের। অথচ, মানুষ ছুটছে ‘ক্যারিয়ার’-এর প্রথম দুটো অর্থের নামে। হ্যাঁ, সেখানে চাকরির কথা আছে, ধারাবাহিকতার ব্যাপার আছে, জীবনের সময় গণনা আছে কিন্তু সুখের কথা নেই, আনন্দের কথা নেই।
তাহলে ‘ক্যারিয়ার’ বলতে সেটাই আগে বুঝব, যে কর্মে আর্থিক সচ্ছলতা আছে কিন্তু আনন্দ আর সুখ নিশ্চিত। যে কাজ করলে জীবনভর আনন্দ পাওয়া যায় এবং সৎ আর সচ্ছলভাবে সংসার চালাবার অর্থ মেলে, এর চেয়ে অন্য কর্ম কী বেশি প্রয়োজন? যে কাজে কোনোই আনন্দ নেই কিন্তু অর্থ আছে সে কাজের পেছনে ছোটার কী দরকার?
যদি তেমন কাজের একেবারেই অভাব হয়, পরে অন্য কিছু ভাবা যায়। তাই চাকরির জন্য প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় যারা নামে এবং বই পড়ে, আমি তাদের বিপক্ষে নই। পক্ষে, কারণ, তারা সৎ। সৎভাবে একটা চাকরি চায় এবং সে কারণে মন দিয়ে বই পড়ে। আমার অনুকম্পা তাদের জন্য, যারা এদের জন্য প্রশ্ন বানাতে পারেন না, পুরোনো প্রশ্ন দিয়ে বারবার পরীক্ষা চালান। একজন ক্যারিয়ার-সচেতন মানুষ তিনিই, যিনি কর্মক্ষেত্রে আনন্দ-সচেতন, সুখ-সচেতন হতে চান শুধু আর্থিকভাবে যেনতেনভাবে বড় হওয়ার পেছনে ছোটেন না। প্রাচীনকালের গুরু-শিষ্যের একটি কাল্পনিক সংলাপ দিয়ে আলোচনা শেষ করা যাক-
গুরু: গুরুগৃহের পাঠ তো শেষ হলো। ভবিষ্যতে কী করবে ভেবেছ?
শিষ্য: ব্যবসা।
গুরু: বেশ। কিন্তু কয়লা আর সুগন্ধী এ দুটোর মধ্যে কোন ব্যবসা তুমি পছন্দ করবে?
শিষ্য: কোনটি করা উচিত গুরু?
গুরু: সুগন্ধীর ব্যবসা।
শিষ্য: কারণ?
গুরু: এতে কোনো দিন তোমার নগদ অর্থলাভ কম হলেও গায়ে সুগন্ধ লেগে থাকবে। আর কয়লার ব্যবসায় অর্থলাভ হলেও সারা গা কালো হয়ে যাবে।
আবার বলছি, সংলাপটি কাল্পনিক। কিন্তু প্রতীকী তো বটেই!