কেন বই পড়ব

প্রতীকী ছবি
অলংকরণ: বাবুল হোসাইন সোহাগ

বইপড়া বিষয়ে একদল মানুষ মনে করেন, বইপত্র পড়ে কোনো লাভ নেই। ছাপা বইপত্র মানুষকে নির্দিষ্ট কাঠামোর মধ্যে ফেলে দেয়। মানুষ অন্যের চিন্তার দাসে পরিণত হয়। কারণ, ছাপা বইয়ে যে উপলব্ধি খোদাই করা থাকে তা অন্যের উপলব্ধি। অন্যের ধার করা উপলব্ধির ভারবাহক হওয়ার কোনো মানে হয় না। এতে শিক্ষাও পূর্ণ হয় না। এর চেয়ে বরং চারপাশের প্রকৃতি বা চলমান জীবনপ্রবাহ পড়াই ভালো। এই পাঠ, শিক্ষা বা জ্ঞান যা-ই বলি না কেন, এটা একান্তই নিজের হয়। জগদ্বিখ্যাত দার্শনিক রুশো এই মতবাদের লোক ছিলেন। আমাদের আশপাশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের মধ্যে সরদার ফজলুল করিম অনেকটা এই মতবাদের মানুষ ছিলেন।

অন্য মতের মানুষও আছেন। তারা মনে করেন, ব্যক্তি-মানুষের জানা ও বোঝার জগৎ ছোট। এই জানা-বোঝার জগৎকে বড় করার প্রধানতম উপায় হচ্ছে বইপড়া। বিচিত্র মানুষ বিচিত্র বইয়ে তাদের নানাবিধ চিন্তার জগৎকে মেলে ধরেছেন। এই বহুবিধ চিন্তার জগতের সাথে বইপড়ার মাধ্যমে যুক্ত হয়ে নিজের ছোট জগৎকে বড় করা যায়। বাংলা ভাষায় রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে প্রমথ চৌধুরী এই মতাদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। বাংলাদেশে এই মতের জীবন্ত উদাহরণ আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। তিনি তার জীবনের প্রায় বারোআনাই ব্যয় করেছেন মানুষকে পড়ানোর ব্রত পালন করে। বই পড়ানোর মাধ্যমে তিনি মানুষকে আলোকিত করতে চেয়েছেন।

একটু গভীরভাবে লক্ষ করলে দেখা যাবে, আসলে এই দুই মতের মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য নেই। দুই পক্ষই মূলত পড়ার কথাই বলে। পার্থক্য এই যে, লেখা বইপড়া আর অলিখিত বইপড়া। দুটোই শেষ পর্যন্ত সেই পড়াই। আসল কথা হচ্ছে, মানুষকে পড়তেই হয়। কারণ, ব্যক্তিমানুষের জানা-বোঝার পরিসর সীমিত। এই পরিসরকে বাড়াতে এবং নিজেকে পূর্ণাঙ্গভাবে গড়তে, জীবন-জগৎকে বুঝতে মানুষকে পড়তেই হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো মানুষও বলেছেন, নিজের জ্ঞানের দীনতা ‘ভিক্ষালব্ধ ধন’ দিয়ে অর্থাৎ অন্যের লেখা বই পড়ে দূর করি। তার ভাষায়, ‘বিশাল বিশ্বের আয়োজন;/মন মোর পড়ে থাকে অতি ক্ষুদ্র তারি এক কোণ।/সেই ক্ষোভে পড়ি গ্রন্থ ভ্রমণবৃত্তান্ত আছে যাহে/অক্ষয় উৎসাহে/... জ্ঞানের দীনতা এই আপনার মনে/পূরণ করিয়া লই যত পারি ভিক্ষালব্ধ ধনে।’ মোদ্দা কথা, প্রকৃতি পাঠ করাই বলি আর কারও লেখা বইপড়া-ই বলি, আসলে মানুষকে পূর্ণাঙ্গ হতে হলে, নিজের ‘দীনতা’ দূর করতে হলে, পড়তেই হয়। শুধু তা-ই নয়, জীবন-জগতের মানে বোঝার জন্যও পড়তেই হয়।

নিজেকে ও জীবন-জগৎকে বোঝার বাসনা জীবজগতে একমাত্র মানুষেরই তো আছে। এই জানা-বোঝার ভেতর দিয়েই মানুষ ঠিক করে যে পৃথিবীকে সুন্দর করার জন্য তার নিজের এবং বৃহত্তর মানব সম্প্রদায়ের কিছু করণীয় আছে। শুধু উদরপূর্তির জন্যেই সে পৃথিবীতে আসে নাই।

তবে কি বইপড়ার প্রধান উদ্দেশ্য পৃথিবীকে বোঝা আর একে সুন্দর করতে নিজের করণীয় সম্পর্কে একটা সিদ্ধান্তে আসা! অবশ্যই বইপড়ার একমাত্র উদ্দেশ্য এটা নয়। বইপড়ার আরও হাজারটি কারণ দেখানো যায়। কিন্তু এখানে শুধু এতটুকু বলা দরকার, বই মানুষ আনন্দের জন্যেও পড়ে। কী সেই আনন্দ!

মানুষ মূলত বাস করে খুবই একঘেয়ে এক পরিবেশের মধ্যে। বনের পশুর এই একঘেয়েমি নিয়ে কোনো ভাবনা নেই। কারণ, জীবনের মানে তো তার কাছে উদরপূর্তি। কিন্তু মানুষের ‘আরও কিছু’ লাগে। বলা যায়, এই ‘আরও কিছু’টাই মানুষের বেশি লাগে। এ জন্য দেখা যায়, মানুষের থাকতে লাগে সাড়ে তিন হাত জায়গা। কিন্তু সে ঘর বানায় অধিকাংশ জায়গা ফাঁকা রেখে। সে বাড়ির সামনে ফাঁকা জায়গায় খাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ফসল না-ফলিয়ে ফুলের গাছ লাগায়। এক অর্থে সময়ের আর অর্থের অপচয় বটে! কিন্তু মানুষ এসব করে। কারণ, তার মুক্তির দরকার হয়। বই তার একপ্রকার মুক্তি। চেনা এবং প্রয়োজনের জগৎ থেকে মুক্তি। এই মুক্তিতে তার আনন্দ। এই আনন্দের জন্য মানুষকে বই পড়তে হয়, সেটা লিখিত বই-ই হোক আর অলিখিত বই-ই হোক।

কিন্তু প্রাইভেট আনন্দের ব্যাপারটার চেয়ে বইপড়ার অন্য গুরুতর দরকারি দিকও আছে। বর্তমান পৃথিবী একমাত্রিকতার জঞ্জালে পরিণত হচ্ছে। মানে, যেকোনো বিষয়কে একদিক থেকে দেখে সিদ্ধান্তের প্রবণতা বাড়ছে। একেই বোধ করি বলা হয় ‘ফ্যানাটিজম’। বই মানুষকে বহু চোখ দেয়। বইপড়া-মানুষ একটা বিষয়কে নানা দিক থেকে দেখার বহুমাত্রিক চোখের অধিকারী হয়; ‘ক্রিটিক্যাল’ হয়। বহুবিচিত্রের কষ্টিপাথরে যাচাই করে বইপড়া মানুষ নিজেকে খাঁটি সোনা বানিয়ে তোলে। এই ‘ক্রিটিক্যাল’ হওয়ার জন্য, বহুমাত্রিক হওয়ার জন্য, শ্রেয়তরকে প্রতিষ্ঠার জন্য বইপড়া দরকার।

তাই আসুন পড়ি, পড়ি এবং পড়ি; সে প্রাকৃতিক পড়াই হোক আর লিখিত বই পড়াই হোক। পড়ার মধ্য দিয়ে নিজেদের জন্য ও পরবর্তী প্রজন্মের জন্য যৌক্তিক এবং সুন্দর পৃথিবী গড়ি।