কালো ছায়া

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

চোখের সামনে ১৫ লাখ টাকা পড়ে আছে। এত টাকার লোভ সামলানো কঠিন। রশিদ মিয়াও ব্যতিক্রম নন। লালদীঘি থানার তদন্ত কর্মকর্তা তিনি৷ ঘুষ ছাড়া কোনো কাজে হাত দেন না৷ টাকা যার বেশি, রশিদ মিয়ার কলম তার পক্ষে কথা বলে। টাকার নেশা বড় খারাপ জিনিস। একবার টাকার নেশা যার ওপর ভর করে, তার চোখে মায়াদয়া, ভালোবাসা কিছুই কাজ করে না। অন্ধ মানুষের মতো তখন সে শুধু টাকার পিছু ছোটে। রশিদ মিয়া ঠিক এ রকম একজন লোক। একটা মামলার জন্য আসামিপক্ষ তার হাতে ১৫ লাখ টাকা তুলে দিয়েছে। মামলার সারাংশ হলো, যৌতুকের জন্য বর, শাশুড়ি ও ননদ মিলে বউকে পিটিয়ে হত্যা করেছেন। পরে লাশ ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে আত্মহত্যার নাটক সাজান। মেয়ের মা তা বিশ্বাস করেননি, তিনি বাদী হয়ে থানায় মামলা করেছেন। সেই মামলার চার্জশিট দেওয়ার সময় হয়েছে, তাই আসামিপক্ষ এই টাকা নিয়ে তার বাসায় হাজির।

রশিদের কাছে বিষয়টি বড় আনন্দের ছিল। কিন্তু পৃথিবীতে খারাপ কাজের আনন্দ ক্ষণস্থায়ী, তার প্রমাণ আবার পেলেন রশিদ। এই বড় অঙ্কের টাকা হাতে পাওয়ার পর তার সামনে বিশাল বড় এক দেয়াল তৈরি হয়েছে। যে দেয়াল টপকে যাওয়ার মতো সাধ্য রশিদের নেই। নারী নির্যাতনে মারা গেছেন যিনি, তার ৭ বছরের মেয়ে আচমকা একদিন রশিদের থানায় এসে হাজির হলো। ময়লাযুক্ত সাদা একটি ফ্রক মেয়েটির গায়ে। সোজা রশিদের চেয়ারের সামনে এসে কোনো ডরভয় ছাড়া বলল, ‘আপনি শুনেছি টাকা খেয়ে আমার মায়ের খুনিদের ছেড়ে দেবেন। আমার কাছে তো বেশি টাকা নেই, আমি এই কিছু টাকা জমিয়ে রেখেছিলাম। আপনাকে সব দিয়ে দিচ্ছি, আপনি দয়া করে এদের সবাইকে ফাঁসি দিয়ে দিন’, এই বলে মেয়েটি পেছন থেকে তার দুই হাত সামনে এনে টেবিলের ওপর ১০ ও ৫ টাকার কিছু নোট রেখে চলে গেল৷ রশিদ হতভম্ব হয়ে গেল। আজ পর্যন্ত কারও সাহস হয়নি রশিদকে এ রকম কথা বলার। এই ছোট্ট মেয়ে কী সাবলীল ভাষায় সব বলে গেল। রশিদ কেন কিছু বলেনি? কেন কড়া ভাষায় কোনো উত্তর দেয়নি?

যারা অন্যায় করে, তারা মানসিকভাবে সব সময় দুর্বল থাকে। এদের কেউ কোনো সত্য কথা বললে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে যায়। নিজের পক্ষে কথা বলতে গেলে তখন তারা ভয় পায়। টাকাগুলো গুনে দেখল রশিদ, ১২২ টাকা মাত্র। কেন জানি ১৫ লাখ টাকার কাছে ১২২ টাকা পরিমাণে দ্বিগুণ মনে হচ্ছে।

কতই তো ঘুষ খেলেন, কিন্তু আজ কেন জানি অশান্তি লাগছে মনে। বাসায় ফিরে দেখলেন, তার একমাত্র মেয়ে তানিয়া বিছানায় শুয়ে আছে। তানিয়ার বয়স আর ওই মেয়ের বয়স প্রায় সমান হবে। চোখ বন্ধ করে চিন্তা করল, আজ যদি তার মেয়ে এমন একটা পরিস্থিতিতে পড়ত, তাহলে কী হতো? দেয়াল থেকে লাফ দিয়ে রশিদের মাথায় একটি টিকটিকি পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে তার ঘোর কেটে গেল।

না, না, না আর চিন্তা করতে পারছেন না রশিদ। এই সব হচ্ছে কী ? কত অন্যায় করলেন, তবে আজ কেন মনুষ্যত্ব জেগে উঠল?

আয়নায় নিজের চেহারার দিকে তাকিয়ে দেখলেন। মানুষের চেহারার মতো মনে হলেও, তার ভেতরে তিনি একটি কালো ছায়া দেখতে পেলেন। সঙ্গে সঙ্গে মনের মধ্যে অশান্তি শুরু হয়ে গেল। সারা রাত আর ঘুম হলো না। ছটফট করলেন তিনি। যারা অপরাধ করে, তারা কোনো দিন শান্তিতে ঘুমাতে পারে না। তাদের মাঝে অদৃশ্য এক ক্লান্তি ভর করে, যা সহজে দূর করা যায় না। রশিদ মিয়ার মাঝে ঠিক এই ক্লান্তি ভর করেছে। জানালা দিয়ে জোছনার আলো ঘরে ঢুকছে, তবু কেন জানি এই ঘর ঘুটঘুটে অন্ধকার লাগছে। কানের কাছে সারা রাত মশা ভনভন করেছে। মনে হয় বলতে চেয়েছে, ‘রশিদ কাজটা ভালো হচ্ছে না, সময় আছে, ভুল ঠিক করে নাও।’

পরদিন সকালে রশিদ পাঁচজনকে আসামি করে আদালতে চার্জশিট জমা দিলেন। যারা যারা খুনের সঙ্গে জড়িত, তাদের সবার নাম তুলে ধরলেন।

রশিদ মিয়ার এই আচরণে চারদিকে হইচই পড়ে যায়। কেউ কেউ এই কাজকে একটি চক্রান্ত বলে মনে করল। খারাপ লোকেরা যদি হঠাৎ ভালো কাজ করে, তবে কেউ তা বিশ্বাস করে না। সবাই তখন এই কাজকে খারাপ কাজ হিসেবে গণ্য করে। কেউ বিচার করতে চায় না, আসলে এটা ভালো না খারাপ। তাই প্রথম দিকে সবাই মনে করে, বেশি টাকা পেয়ে বাদীপক্ষের অনুকূলে তিনি তার চার্জশিট দিয়েছেন।

রশিদের কাছে থাকা ১৫ লাখ ১২২ টাকা সেই ছোট মেয়েটির নামে একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলে ফিক্সড ডিপোজিট করে দিলেন।

টিলাগড়, সিলেট