কাঁটা

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

মাছের কাঁটাটা আলমগীর সাহেবের গলায় খচখচ করছে। কাঁটাটা এমন জায়গায় বিঁধেছে যে কোনোভাবেই আরাম হচ্ছে না। আজ দুপুরেই কাঁটাটা বিঁধেছে। তিনি শুকনো ভাত খেয়েছেন, কলা খেয়েছেন এবং গলার ভেতর আঙুল ঢুকিয়ে তা বের করারও চেষ্টা করেছেন। কোনো লাভ হয়নি। উল্টো কাঁটাটা এমন জায়গায় গিয়ে বসেছে যে না যাচ্ছে গলার ভেতর, আবার না আসছে বাইরে। কাঁটাটি ইলিশ মাছের। মাছের রাজা ইলিশ। সম্ভবত কাঁটার রাজও তাই। খুব যন্ত্রণা দিচ্ছে। সাবধানেই খাচ্ছিলেন ইলিশ মাছের টুকরোটি। পেটির মাছটাই তাকে খেতে দেয়। তারপরও একটা পাতলা কাঁটা খ্যাঁচ করে বিঁধে গেল। তিনি বিষম খেলেন। কিন্তু তিনি তার ছেলে বা বউমাকে কিছুই বুঝতে দিলেন না। এই বয়সে কাঁটা ফুটেছে শুনলে বিচ্ছিরি ব্যাপার হবে। এমন ভাব করলেন যেন গলায় ভাত আটকে গেছে। অভিনয় সম্ভবত ভালো হলো না। তার ১০ বছরের নাতনি ঠিকই বুঝে গেল। খুব চালাক মেয়ে। মাত্র ক্লাস ফোরে পড়ে। এই বয়সেই রাজ্যের জ্ঞান। এখনকার বাচ্চাকাচ্চারাই মনে হয় এ রকম। সব হয়েছে মোবাইল ফোনের জন্য। সারা দিন কী সব ঘাঁটাঘাঁটি করে। অথচ তার একটা আদিকালের বাটন ফোন। ফেসবুক-টেসবুক না কী সব আছে মোবাইলে। সারা দিন তাই নিয়ে পড়ে থাকে। তিনি কাঁটা নামানোর জন্য শুকনো ভাত দলা করে মুখে দিচ্ছিলেন। তার নাতনি বলে উঠল দাদুর কাঁটা ফুটেছে? তিনি দুপাশে জোরে মাথা ঝাঁকালেন। বেঁধেনি। কিন্তু এবারও অভিনয়ে কাজ হলো না। বরং সবাই বুঝে গেল যে তার কাঁটাই ফুটেছে। কারণ, কাঁটার ব্যথায় তার চোখে জল এসে গেছে। তার ছেলে ফয়সাল তো বলেই বসল, একটু দেখেশুনে মাছটা খাবে না, বাবা? ইলিশ মাছে তো প্রচুর কাঁটা থাকে। পেটির মাছও বাছতে পারো না! তোমার বয়সী তো পাশের বাসার আসিফ সাহেবও আছেন।

কী শক্তপোক্ত এখনো। আর তুমি এই বয়সেই মুষড়ে গেছ! আলমগীর সাহেবের মনে পড়ল ফয়সালের ছেলেবেলার কথা। বড় হয়েও তাকে কাঁটা বেছে দিতে হতো। কলেজে পড়ার সময় থেকে তাকে আর কাঁটা বেছে দিতে হতো না। তাকে বয়সের কথাটা মনে না করালেও চলত। তিনি ভালোই বুঝতে পারেন। শুধু তার বউমা কিছুই বলল না। হাত দিয়ে জলটা এগিয়ে দিল শুধু। আর বলল, ভাতটাত দলা করে খেলে কিছু হবে না। আমার কাছে হোমিওপ্যাথিক আছে, কয়েকবার খেলেই কাঁটা গলে যাবে। তিনি হোমিওপ্যাথিকে খুব বেশি বিশ্বাস করেন না। কিন্তু এই কাঁটার ব্যাপারে হোমিওপ্যাথির চেয়ে আর ভালো কোনো ওষুধ নেই। ছেলেবেলায় তার যতবার গলায় কাঁটা ফুটেছে ততবার হোমিওপ্যাথিকেই গেছে। ম্যাজিকের মতো ব্যাপার! কাঁটা গলে যায়। ভাগ্যিস, বউমার কাছে ছিল! না হলে তাকে আবার যেতে হতো তারই বন্ধু হরিচরণের কাছে। বাজারের মোড়েই তার হোমিওপ্যাথিকের দোকান। ওষুধ ভালোই দেয়। কিন্তু ব্যাটার ইয়ার্কিটা সহ্য হয় না। গেলেই হয়তো বলে বসবে, ‘কী হে, আজকাল আবার তাড়াহুড়ো করে মাছ খেতে হচ্ছে যে! অবসর নিয়ে আবার কোনো কাজটাজ করতে হচ্ছে নাকি! তোমার ছেলে তো বেশ ভালোই ইনকাম করে শুনেছি! ঘুষটুষও খায় শুনেছি! ওই লোকে দু–চার কথা বলাবলি করে আরকি!’ এসব কথা শুনলে তার পিত্তি জ্বলে যায়। যদিও ঘুষ খাওয়ার কথাটা মিথ্যে নয়। মাত্র পাঁচ বছরেই তার ছেলে এই ফ্ল্যাট কিনেছে। আর জমিও কিনেছে বলে শুনেছেন। চালচলন বড়লোকি হালের। সামান্য চাকরি করে যে এত কিছু করা যায় না, সেটা তিনি বেশ জানেন। তিনিও তো সরকারি চাকরি করতেন। তার কাছে তো রিটায়ার্ডের টাকা ছাড়া আর কোনো টাকাই নেই। রাজার হালে চলতেও পারেননি। আর যে টাকা তিনি সঞ্চয় করেছিলেন ছেলের চাকরি দিতেই তা প্রায় খরচ হয়ে গেল। তারপর আবার গত বছর তার পাকস্থলীর অপারেশনে সবটুকুই খরচ হয়েছে। তার ছেলেও অবশ্য দিয়েছে। কিন্তু ফয়সালের এই ঠাটবাট তার কাছে ভালো লাগে না। তিনি আকারে–ইঙ্গিতে সেটা ছেলেকে বলেছেনও। কিন্তু কে শোনে তার কথা! তিনি আর কিছু বলতে যান না।

হিসাব করে দেখলেন তার বয়স এখন তেষট্টির কাছাকাছি। তিনি যদি তার বাবার বয়সেও মারা যান তাহলেও আর বছর দশেক বাঁচার কথা। তারা বাবা মারা গিয়েছিল তিয়াত্তর বছর বয়সে। মাত্র বছর দশেকই তো! চোখ–কান বুজে চালিয়ে দিলেই হলো। হরিচরণের হোমিওপ্যাথি খাওয়ার চেয়ে বউমার কাছে ওষুধ খাওয়া ঢের ভালো। খানিকটা লজ্জা লজ্জা করবে। কী আর করার! আলমগীর সাহেব সরকারি হাইস্কুলের শিক্ষক ছিলেন। দুই বছর ধরে রিটায়ার্ড করেছেন। এক জায়গাতেই তার চাকরি শেষ হয়েছে। রিটায়ার্ডের পর থেকে তার ধারণা বয়সটা দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে। কোনো কাজ আগের মতো দ্রুততার সঙ্গে করতে পারেন না। এই যেমন আজ সকালে দাড়ি শেভ করতে গিয়ে আগের চেয়ে অন্তত ২০ মিনিট বেশি সময় নিয়েছেন। শেষ দিকে একটু কেটেও গেছে। তার বউমা দেখে বলল, ‘একটু সাবধানে শেভ করবেন, বাবা।’ মেয়েটি ভালো। শুধু ভালো না অসম্ভব ভালো। তিনি তার ছেলের বউকে দেখলে লজ্জা পান। যদিও লজ্জার কোনো কারণ নেই। তবু ইতস্তত ভাবটা যায় না। খাওয়া শেষে তার বউমা তার ঘরে ওষুধ নিয়ে আসে।
‘দেখি বাবা, হাতটা দিন।’
আলমগীর সাহেব হাত বাড়িয়ে দেন। হাতের ওপর কয়েকটি সাদা বড়ি দিয়ে সেগুলো খেয়ে নিতে বলেন।
‘ফয়সাল ঘুমিয়েছে?’
তার বউমা চলে যাচ্ছিল। প্রশ্ন শুনে দাঁড়াল। মেয়েটি বেশ বুঝতে পেরেছে যে তিনি কিছু একটা বলতে চান।
‘জি¦বাবা, ঘুমিয়েছে। আপনি কি কিছু বলবেন?’
‘একটু বসো মা। তোমার সাথে দুটো কথা আছে।’
সাহিদা বসে। তার বউমার নাম সাহিদা। উম্মে কুলসুম সাহিদা। তিনি সাহিদা বলেও ডাকেন।

‘শোনো মা, আমার ছেলেকে আমি এসব বলতে পারব না বলেই তোমাকে বলছি। ফয়সাল যে চাকরি করে প্রচুর টাকা বেতনের বাইরেও আনে সেটা তুমি জানো?’
‘জানি বাবা।’
‘তুমি কিছু বলোনি? মানে ফয়সালকে নিষেধ করোনি? বাইরের মানুষ দু–চার কথা বলাবলি করে। আমি সারা জীবন শিক্ষকতা করেছি। আর আমার ছেলে যদি এসব করে তাহলে মানসম্মান থাকে না। ওকে বোঝাও।’
‘আমার নিষেধ আপনার ছেলে শোনে না। আমার তো বাবা আলিশান বাড়ি দরকার নাই। এত দামি খাওয়ার দরকার নাই। আমার বাবার বাড়ি মধ্যবিত্ত পরিবারের। আমার এসবে অভ্যেসও নেই। আমি বুঝিয়েছি। এসব বলেও কোনো লাভ হয়নি। উল্টো আজেবাজে কথা বলে। আপনি বলেন যদি কোনো কাজ হয়।’
‘শোনো মা, যখন মানুষ দুহাতে টাকা উপার্জন করে তখন সে থাকে এক ঘোরের মধ্যে। সেই ঘোর থেকে বের করে আনার দায়িত্ব মানে সৎ পথে ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব তার স্ত্রীর।’
‘আমি কী করব, বলে দেন বাবা।’
‘তাকে বোঝাও। আমাদের এত টাকা দরকার নাই।’
আলমগীর সাহেবের এই কথায় ফল হলো উল্টো। ফয়সালকে বলাতে পরদিন বিকেলেই বাবার ঘরে এসে হাজির।
‘বাবা, তুমি সাহিদাকে কী বলেছ?’
‘কি বলেছি?’

‘তুমি বলেছ, আমি ঘুষ খাই। অবৈধ টাকা উপার্জন করি। এসব বন্ধ করতে?’
‘হ্যাঁ বলেছি। তুই কি এসব করিস না? মানুষ আমাকে নানা কথা বলে।’
‘এসব আজকাল সবাই করে। একটু ভালো থাকার জন্য মানে তোমাদের ভালো রাখার জন্য আমাকে এটুকু করতেই হয়। যে বেতন পাই তা দিয়ে টিনের ঘরেও থাকতে পারতে না। বুঝলে? সস্তা সেন্টিমেন্ট নিয়ে চললে আজকাল চলা যায় না।’
‘আমি তো তোর কাছে ফ্ল্যাটে থাকতে চাইনি। আমি যে সারা জীবন ঘুষ খাইনি তাতে আমার চলেনি?’
‘যুগ পাল্টেছে, বাবা। একটু আপডেট হও। আর না হতে পারলে...?’
শেষ কথাটা শেষ হয় না। তার আগেই ফয়সাল উঠে চলে যায়।

আলমগীর সাহেব চুপচাপ কিছুক্ষণ বসে থাকেন। শেষ কথাটা কী, সেটা বুঝতে তার কষ্ট হয় না। তার স্ত্রীর কথা মনে পড়ে। বেচারা সারা জীবন তার অল্প বেতন দিয়ে সংসার করেছে। কোনো দিন বুঝতেও দেয়নি। এসব কথা ভাবতে গিয়ে আলমগীর সাহেবের চোখটা ভিজে ওঠে। তার গলার কাঁটাটা আবার খচখচ করতে শুরু করেছে। হোমিওপ্যাথিকে কাজ করছে না মনে হয়। তবে গলার কাঁটার চেয়ে বুকে যে কাঁটা এইমাত্র বিঁধল, সেটাই বেশি যন্ত্রণা দিচ্ছে। এর ওষুধ নিশ্চয়ই বউমার কাছে নেই। হরিচরণকে একবার জিজ্ঞেস করা যেতে পারে। তিনি আস্তে আস্তে বাইরে বেরিয়ে যান। তবে যাওয়ার আগে তার সঙ্গে প্রয়োজনীয় কিছু কাপড়চোপড় গুছিয়ে নেন।