বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে একটি উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম জহির রায়হান। কিংবদন্তি ব্যক্তিত্ব জহির রায়হান একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, ভাষাসৈনিক, সাংবাদিক, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, প্রাবন্ধিক, আলোকচিত্রী, বিপ্লবী চলচ্চিত্রকার, নাট্যকার ও প্রযোজক। প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাঁর ছিল সরব উপস্থিতি ও সফল পদচারণ। লেখক হিসেবে জহির রায়হান যেমন পাঠকনন্দিত, তেমনি একজন সফল চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবেও তিনি ব্যাপকভাবে সমাদৃত। ছাত্রজীবন থেকে বিপ্লবের মন্ত্রে উজ্জীবিত এই গুণী সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব তাঁর মননে, লেখায় ও নির্মিত সিনেমায় বিপ্লবকে বলিষ্ঠভাবে ধারণ করেছেন। তিনি দেশের আপামর জনসাধারণকে বিপ্লবের স্বপ্নে বিভোর করে তুলেছিলেন। পৃথিবীর সব অন্যায় ও শোষণের বিরুদ্ধে তাঁর কলম ও ক্যামেরা ছিল সোচ্চার ও সদা তৎপর।
জহির রায়হান ১৯৩৫ সালে ফেনী জেলার সোনাগাজী উপজেলার নবাবপুর ইউনিয়নের মজুপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আসল নাম আবু আবদাল মোহাম্মদ জহিরুল্লাহ, ডাকনাম জাফর। তাঁর পিতা মাওলানা মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ ছিলেন কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসার শিক্ষক। তাই তাঁরা পরিবারসহ কলকাতায় থাকতেন। ১৯৪০ সালে কলকাতা মডেল স্কুলে ভর্তির মধ্য দিয়ে তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া শুরু হয়। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর তিনি পরিবারের সঙ্গে কলকাতা থেকে বাংলাদেশে চলে আসেন। ১৯৫৮ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন।
জহির রায়হান কলকাতার বিখ্যাত মিত্র ইনস্টিটিউটে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময়ে বড় ভাই শহীদুল্লা কায়সারের প্রভাবে প্রথম রাজনৈতিক সংস্পর্শে আসেন। তখন কমিউনিস্ট পার্টির জন্য তিনি কলকাতার রাস্তায় ‘স্বাধীনতা’ পত্রিকা বিক্রি করতেন। রায়হান নামটি তিনি রাজনৈতিক সূত্রে পেয়েছেন।
ঢাকা কলেজে ইন্টারমিডিয়েট পড়াকালীন জহির রায়হান কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হন। তিনি এক স্থান থেকে অন্য স্থানে চিঠি ও সংবাদ পৌঁছে দিতেন। প্রত্যেক কর্মীর পার্টি থেকে একটি নাম দেওয়া হতো। তাঁর পার্টি নাম ‘রায়হান’ রেখেছিলেন বামপন্থী রাজনীতিবিদ কমরেড মণি সিংহ। রাজনৈতিক নাম রায়হান গ্রহণ করে তিনি পরিচিত হয়ে ওঠেন জহির রায়হান নামে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তিনি ছাত্র ইউনিয়নের নেতা ছিলেন। পৃথিবীব্যাপী রাজনৈতিক অস্থিরতা তাঁকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে।
জহির রায়হান ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। ১৯৪৫ সালে তিনি ভিয়েতনাম দিবসের মিছিলে অংশগ্রহণ করেন। ছাত্রজীবনে রাজনৈতিক কারণে একাধিকবার জেলে গিয়েছেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মিছিল করতে গিয়ে গ্রেপ্তার হন ও কারাবরণ করেন। ২১ ফেব্রুয়ারি যে ১০ জন ব্যক্তি প্রথম ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করেন, তিনি তাঁদের একজন। ১৯৬৯ সালের গণ–অভ্যুত্থানের সময়ও তিনি আন্দোলনে যোগ দেন।
স্কুলজীবন থেকেই তাঁর লেখালেখির শুরু। প্রথম প্রকাশিত রচনা কবিতা ‘ওদের জানিয়ে দাও’। ১৪ বছর বয়সে লিখিত এ কবিতায় তিনি নিরীহ নিরস্ত্র মানুষের প্রতি গভীর ভালোবাসা ও তাদের দুঃখবোধের কথা তুলে ধরেছেন। ১৯৫০ সালে শুরু হয় তাঁর সাংবাদিক জীবন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া অবস্থাতেই ১৯৫৫ সালে তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘সূর্যগ্রহণ’ প্রকাশিত হয়। ১৯৬০ সালে তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘শেষ বিকেলের মেয়ে’ প্রকাশিত হয়। হাজার বছর ধরে, আরেক ফাল্গুন, বরফ গলা নদী, আর কত দিন তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাস। ১৯৬৪ সালে তিনি ‘হাজার বছর ধরে’ উপন্যাসের জন্য আদমজী সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৯৯ সালে সাহিত্যে অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করে।
জহির রায়হান ১৯৫৬ সালে চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশ করেন। পরিচালক হিসেবে তাঁর প্রথম ছবি ১৯৬১ নির্মিত ‘কখনো আসে নি’। এরপর নির্মাণ করেন সোনার কাজল, কাঁচের দেয়াল, সঙ্গম, বাহানা, বেহুলা, আনোয়ারা ও জীবন থেকে নেয়া সিনেমা। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের পুরস্কার পায় ‘কাঁচের দেয়াল’। জহির রায়হান অর্জন করেন শ্রেষ্ঠ পরিচালকের সম্মাননা। তাঁর ‘জীবন থেকে নেয়া’ বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে স্বীকৃত। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্মম গণহত্যা নিয়ে তিনি ‘Stop Genocide’ নামক প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেন। এটিকে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ডকুমেন্টারি বলা হয়। ১৯৭৭ সালে তিনি একুশে পদক লাভ করেন।
বাংলা চলচ্চিত্রের প্রবাদপুরুষ জহির রায়হান শোষিত মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে হাতিয়ার হিসেবে সাহিত্য ও চলচ্চিত্র মাধ্যমকে ব্যবহার করেছেন। নিখোঁজ বড় ভাই শহীদুল্লা কায়সারকে খুঁজতে ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি তিনি মিরপুরে যান। এরপর তাঁকে আর পাওয়া যায়নি। মাত্র ৩৭ বছরের জীবনে এই ক্ষণজন্মা নক্ষত্রের কর্মপরিধি ছিল ব্যাপক। আমাদের সাহিত্যে ও চলচ্চিত্রে তাঁর অবদান চিরস্মরণীয়।