করোনাকালে সাগরকন্যায়

করোনাকালে সাগরকন্যায়।
ছবি: সংগৃহীত

বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রাখলেও দূরে কোথাও ভ্রমণে বাড়ি থেকে কঠোর নির্দেশনা ছিল। সেই নির্দেশনা থেকে বের হওয়া অসম্ভব হয়ে উঠছিল। ২০২০ সালের শুরু থেকে দেশে পড়েছে মহামারির ধাক্কা। বন্ধ হয়ে আসে ক্যাম্পাস। ফিরে যেতে হয় বাড়িতে। তাই পূর্বের নির্দেশনার শিকল আরও শক্তপোক্তই হলো। কয়েক মাস কেটে যায় কোয়ারেন্টিনে। ঘিরে ধরে মানসিক বিষণ্নতা। মন চাচ্ছিল প্রাচীর ভেঙে বেরিয়ে পড়তে, মনের দরজা খুলে উদার আকাশের সঙ্গে নীল সমুদ্রের মিতালি দেখে আসতে। মন-মেজাজের ওপরে চেপে বসা মস্ত বড় পাহাড়টি নামানো খুব দরকার বোধ করছিলাম। করোনার কিছুটা শিথিলতা সে সুযোগ এনে দেয়৷ নানাভাবে বুঝিয়ে পরিবারকে রাজি করাতে সক্ষম হই! ক্যাম্পাসের বন্ধুদের সঙ্গে এত দূরে ভ্রমণ। তাও জীবনে প্রথমবার। সেই উত্তরবঙ্গ থেকে দক্ষিণবঙ্গ, রংপুর থেকে কুয়াকাটা! মেয়ের আরজি রাখতে হয়তো শেষমেশ অনুমতি দিয়ে দিলেন বাবা!

পটুয়াখালীর কুয়াকাটা নিয়ে আমার প্রবল আগ্রহ। তা–ও বহু পুরোনো। সাগরকন্যা দেখব। ২০ কিলোমিটারজুড়ে দীর্ঘ সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গে নোনাজলের খেলা এবং একই স্থানে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখার সেই আকাঙ্ক্ষা পূরণ হতে চলেছে জেনে শিহরিত হলাম! তার ওপর ক্যাম্পাসের বন্ধুদের সঙ্গে ভ্রমণ। এ আনন্দ বাঁধনহারা!

ভ্রমণের সবকিছু প্রস্তুত। ব্যাগ গুছিয়ে নিলাম। এরপর যাত্রা শুরু। আমি বের হয়েছি রংপুর থেকে। প্রথমে গেলাম ঢাকায়। সেখান থেকে সদরঘাটের লঞ্চে উঠে বসলাম। জীবনে প্রথমবার লঞ্চভ্রমণের শিহরণই আলাদা। নদীর জলের ওপর দিয়ে এগিয়ে চলা। তার সঙ্গে রাতভর লঞ্চের ছাদে বন্ধুদের গান-আড্ডা-গল্পে কোন সময় যে লঞ্চ তীরে ভিড়ল টেরই পেলাম না। রাতের ভ্রমণ সত্যি দুর্দান্ত! আনলিমিটেড ফানের সঙ্গে নদীর জলের ওপর পড়া রাতের জ্যোৎস্নায় পুলকিত হচ্ছিলাম বারবার। লঞ্চে উঠেই শূচির আনন্দ দেখে কে! খুশিতে বরিশালে বিয়ের সিদ্ধান্তও নিয়ে ফেলেছিল সে!

করোনাকালে সাগরকন্যায়।
ছবি: সংগৃহীত

লঞ্চভ্রমণ শেষ। আমরা পৌঁছে যাই বরিশালে। সেখান থেকে রেদোয়ান, আর বাসে অনভ্যস্ত সাবিনাকে সাথে নিয়ে রওনা হই পটুয়াখালী। আর সেখান থেকে সাগরকন্যা কুয়াকাটায়। ততক্ষণে প্রায় দুপুর ঘনিয়ে এসেছে। সমুদ্র বাড়ি রিসোর্টে নেমেই দেখা মিলল শামীম আর আব্দুল্লাহর। ভোররাত থেকেই তারা অপেক্ষা করছিল। আমাদের অপেক্ষার প্রহর শেষ। সব বন্ধু একসঙ্গে হলাম বহু মাস পর। কিছুটা আলাপ সেরে নিই। চলে হায়-হ্যালো পর্ব। তারপর খানিকটা বিশ্রাম! একটু পর বিশ্রামপর্বে বাদ সাধল আবির-শাকিল। চিৎকার-চেঁচামেচি। অপেক্ষা আর নয়। সমুদ্রে যেতে হবে, জলে সাঁতার কাটতে হবে। তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে পড়লাম৷ তবে তানভীর নেই সাথে। বেচারা সবকিছু সামলাতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। পুরো ট্যুরের খুঁটিনাটি তানভীরই খেয়াল রেখেছে। বলা যায় সে আমাদের ট্যুর গাইড।

করোনাকালে সাগরকন্যায়।
ছবি: সংগৃহীত

জার্নিতে থাকায় ক্ষুধা টের পাইনি এতক্ষণ। এবার পেট চোঁ চোঁ করছে৷ সেই আগের দিন সন্ধ্যায় খেয়েছিলাম লঞ্চে ওঠার আগে! তারপর খাওয়ার কথা ভুলেই গিয়েছি। একদিন পর স্থানীয় সামুদ্রিক মাছের সুস্বাদু রান্নায় ক্ষুধা নিবারিত হলো ভালোভাবেই।

সমুদ্রের তীর ধরে হাঁটছি। ঢেউগুলো আছড়ে পড়ছে চারিদিকে। তীরহারা এই ঢেউয়ের সাগর সানন্দে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে। ওদিকে তপ্ত রোদ। সূর্য তার সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। মস্তিষ্কে এসে আঘাত করছে তীব্র রোদের ঝিলিক। একটা ছাতা খুঁজছিলাম। কিন্তু ছাতা আবার কোথায় পাই! সে চিন্তা বাদ দিলাম। থাক না; একবারই তো এসেছি এমন ভ্রমণে।একটু না হয় রোদ খেলাম! কিন্তু না। তা হতে দিল না বন্ধুরা। ছাতা একটা জোগাড় হয়েছে শেষে!

করোনাকালে সাগরকন্যায়।
ছবি: সংগৃহীত

সূর্যের দাপট শেষে শুরু হয়ে যায় মিষ্টি রোদের বিকেল। এবার তীরের ঢেউতে রোমাঞ্চকর পরিবেশ। এ পাশে প্রেম-অপ্রেম দ্বন্দ্ব মিলিয়ে আমার শাড়ির আঁচলও খানিকটা ভিজল সমুদ্রের জলে! গোধূলিবেলায় রক্তবর্ণের সূর্যের বিমূর্ত অবস্থান দেখে বারবার প্রশ্ন করছিলাম নিজেকে নিজে, ‘আরও আগে কেন আসিনি সাগরকন্যায়!’

লেখক: শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়