একটুখানি সুখ

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

‘কই রে। জলদি খাবার দে।’ সখিনা চুপ করে বসে আছে। কাসিম আবার বলল, ‘শুনতে পারছিস না? খাবার চাইছি।’ সখিনা উত্তর দিল, ‘কোথা থেকে খাবার দেব? আজ সাত দিন তুমি কোনো কাজে যাও নাই। ঘরে একমুঠো চালও নাই। আমি কীভাবে তোমার মুখে ভাত তুলে দিই, তুমি কী জানতে চেয়েছ কোনো দিন? যা দুপয়সা আয় করো, তা দিয়ে গাঞ্জা গিলতে চলে যাও। আবার সময়মতো ভাত চাইতে আইছ। লজ্জা করে না তোমার? ঈদের আর দুই দিন মাত্র বাকি। ছেলে-মেয়ের একটা নতুন জামা দেওয়ার কোনো মুরোদ হয়নি তোমার। আমার হয়েছে যত জ্বালা’, এই বলে সে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। কাসিম লাল টকটকে চোখজোড়া গোল্লা করে বলল, ‘একমুঠো ভাত দিস বলে তোর গায়ে এত জ্বালা? দাঁড়া দেখাচ্ছি মজা,’ এই বলে থালা-বাটি-ঘটি ফেলে দিল উঠানে।

কাসিমের দুই ছেলে, এক মেয়ে। বড় ছেলে সাজুর বয়স ১০ বছর, ছোট ছেলে রাজুর বয়স ৭ বছর। আর মেয়ে মিলির বয়স ৪ বছর। সাজু পেটেভাতে থাকে একটা গ্যারেজে। কাসিমের বউ সখিনা কাজ করে পরের বাড়িতে। কাসিম এক দিন রিকশা চালালে তিন দিন বসে বসে তাস খেলে, গাঞ্জা টানে। সংসারের কোনো খোঁজখবর রাখে না। বউটা সারা দিন হাড়ভাঙা খাটুনি করে সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরে। নিজে না খেয়ে মালিকের বাড়ির ভাত এনে সবাই মিলে ভাগ করে খায়। রাজু আর মিলি সারা দিন ক্ষুধার্ত পেটে বসে থাকে মায়ের পথের দিকে। কখন আসবে মা। কখন একমুঠো ভাত খেতে পারবে। ওদের ঝগড়া শুনে এলেন পাশের বাড়ির সাহানা ভাবি। খুবই অমায়িক। শিক্ষকতা করেন। সময়ে-অসময়ে তাদের সাহায্য করেন। ছোট ছেলেমেয়ে দুটোকে পড়িয়ে দেন। তিনি দু-এক পা ফেলতে ফেলতে সখিনার উঠানে এসে দাঁড়ালেন। সখিনাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী হয়েছে সখিনা? থালা-বাটির এই হাল কেন?’ সখিনা উত্তর দিল, ‘কী আর বলব আপা। সবই আমার কপালের দোষ। তা না হলে এমন স্বামী কপালে জুটবে ক্যান? কোন পাপের শাস্তি আল্লায় আমায় দিছে কে জানে। এর চেয়ে মরণও ভালো। আর সইতে পারি না আপা।’

সাহানাকে দেখে কাসিম ঘরের ভেতর চুপ করে রইল। সাহানা কাসিমকে জিজ্ঞেস করল, ‘ছেলে-মেয়ের জন্য কি কাপড় কিনেছ কাসিম?’ কাসিম কোনো উত্তর দিল না। সখিনা বলল, ‘সে কপাল কি ওরা করে আইছে, বাবার হাতের জিনিস পরার? এ জীবনে আমার কিছু দেই নাই, আবার ছেলেমেয়ে।’ এমন সময় সাজু কাজ সেরে বাড়ি ফিরল। সাজুর মালিক সাজুকে প্রতিদিন ২০ টাকা করে দেয়। সাজু ১০ টাকা নিজের জন্য খরচ করে। আর ১০ টাকা মাটির ব্যাংকে জমা রাখে। সেটা পরিবারের কাউকে জানায় না। সাজু ভাবল, ব্যাংকটা ভেঙে দেখব ঈদে সবার জন্য কিছু কিনতে পারে কি না। গত বছর ঈদের পর থেকে এই টাকা খুব কষ্ট করে রেখেছে। মাঝেমধ্যে কোনো কাস্টমার কাজের জন্য খুশি হয়ে বকশিশ দিলে সাজু তা খরচ না করে সেটাও ব্যাংকে জমা রাখে। সে কাউকে কিছু না বলে পরের দিন সকালে মাটির ব্যাংকটা প্যাকেটে করে গ্যারেজে নিয়ে গেল।

মাটির ব্যাংকটা ভেঙে টাকাগুলো গুনল সাজু। ৪ হাজার ৮০ টাকা। তার চোখ দুটো খুশিতে চকচক করে উঠল। মায়ের কথা ভাবতেই সাজুর চোখ থেকে পানি পড়ল। ‘আহা রে, মা আমার কত কষ্ট করে খাওয়ায়। হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে। বাপটা যে কী! মায়ের কোনো দিন একটু সুখ দিতে পারল না।’ আজ প্রথম সে মায়ের জন্য একটা শাড়ি কিনল। শাড়িটা বুকের সঙ্গে ধরে খুশিতে কেঁদে ফেলল। মনে মনে বলল, ‘মা তোর সাজু কোনো দিন তোকে কষ্ট দেবে না। বাপ দেখে না তো কী হয়েছে, আমি তো আছি। আর কয়টা বছর দেরি কর। আমি আর একটু বড় হলে তোকে আর পরের বাড়ি কাজ করতে দেব না মা।’ সে বাপের জন্যও একটা পাঞ্জাবি, ভাইয়ের জন্য জামা, আদরের বোন মিলির জন্য লাল ফ্রক, জুতা, ফিতা, রেশমি চুড়ি, মেহেদি কত কিছু কিনল। সেমাই, চিনি, মুরগি সব কিনল।এদিকে সখিনা ভেবে অস্থির। কান্নায় বুকটা তার খান খান হয়ে যাচ্ছে। রাত পোহালেই ঈদ। ছেলে-মেয়ের মুখে কিছুই তুলে দিতে পারবে না। জামাকাপড় তো দূরের কথা। একটু সেমাইও না। এমন সময় সাজু মা মা করে ডাকতে ডাকতে ঘরে ঢুকল।

সাজুর হাতে অনেক জিনিসপত্র দেখে মা অবাক হয়ে গেল। সখিনা সাজুকে বাজান বলে ডাকে। সখিনা জিজ্ঞেস করল, ‘বাজান তোর হাতে এত সব কী?’ সাজু হাসিমুখে মায়ের হাতটা ধরে কাছে বসাল। শাড়িটা বের করে মাকে জড়িয়ে ধরল। তারপর একে একে সবার জামাকাপড় বের করে দিল। ‘এত টাকা কই পাইছস বাজান?’ সাজু সব কথা খুলে বলল। সখিনাও ছেলেকে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘বাজান রে তোর মতো ছেলে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।’ খুশিতে সাজুর চোখে-মুখে, কপালে চুমু খেতে খেতে বলল, ‘আল্লাহ আমার বাজানরে আমার মাথায় যত চুল, তার চেয়ে বেশি হায়াত দিক।’ রাজু, মিলি খুশিতে ডগমগ হয়ে গেল। এমন খুশির দিন সাজু এর আগে কখনো দেখেনি। মায়ের এই খুশিভরা মুখখানা স্বর্গের চেয়েও দামি মনে হলো। এদিকে কাসিম ঘর থেকে বের হয়ে সাজুকে ধরে কেঁদে দিল। সাজু বাবার চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বাবাকে পাঞ্জাবিটা পরিয়ে দিয়ে বলল, ‘আমার বাবাকে কত সুন্দর লাগছে।’ কাসিম সাজুকে বুকে ধরে বলল, ‘আমি এবার থেকে কাজ করব বাবা। তুই আমার চোখ খুলে দিয়েছিস। আমাকে তোরা মাফ করে দে।’ ঈদের চাঁদ সেদিন সত্যিই সখিনার আঙিনাতে নেমেছিল। ওদের খুশির জোয়ারে আকাশ-বাতাসও মুখর ছিল। একটুখানি সুখ দিয়ে সেদিন কিনেছিল এক স্বর্গ পৃথিবী। সাহানা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল খুশির বন্যা। নিজের অজান্তে দুফোঁটা আনন্দাশ্রু গড়িয়ে পড়ল সাহানার চোখ থেকে।