এ যেন অচেনা পৃথিবী

২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সকালে রানা প্লাজা ধসে ১ হাজার ১৩৬ জন শ্রমিক নিহত হন। আহত হন আরও সহস্রাধিক
ফাইল ছবি

শনিবারের সকালবেলাটা অন্য রকম। গত কয়েক দিনের অসহ্য গরম নেই। মেঘে ঢাকা পড়েছে সূর্য। মনে হলো, প্রকৃতিও উদ্ধারকাজে নেমেছে। তবে হাজার হাজার মানুষের পায়ের ধুলায় ঢেকে গেছে এনাম হাসপাতাল ও অধর চন্দ্র স্কুলমাঠের আকাশ-বাতাস। মাঠে এই মুহূর্তে কত মানুষ প্রিয়জনের অপেক্ষা করছেন, সেটা অনুমান করা যাচ্ছে না। কিন্তু এটা প্রায় নিশ্চিত যে কেউ জীবিত মানুষের জন্য অপেক্ষা করছেন না, অপেক্ষা করছেন লাশের জন্য। তাঁরা যাঁদের দেখবেন, এঁরা সবাই লাশ। অপেক্ষা শুধু লাশ গ্রহণের। অধর চন্দ্র স্কুলের লম্বা বারান্দা। সারি সারি লাশ রাখা হয়েছে। লাশগুলো পড়ে আছে শনাক্ত হওয়ার অপেক্ষায়। প্রিয়জনের জীবন নয়, লাশটুকু ফিরে পাওয়ার পর অনেকে আনন্দে অথবা দুঃখে চিৎকার করে কাঁদছেন। আমরা কেউ জানি না, এ কান্নার শেষ কোথায়। এনাম হাসপাতালে, অধর চন্দ্র স্কুলের মাঠ, রানা প্লাজার আশপাশ ভারী হয়ে আছে স্বজন হারানো মানুষের আহাজারিতে। সাভারের বিভিন্ন দেয়ালে, বিশেষ করে অধর চন্দ্র স্কুলের মাঠের দেয়ালজুড়েই নিখোঁজ মানুষের ছবি ও ঠিকানা। এই মানুষগুলো হয়তো আর কোনো দিন নির্দিষ্ট ঠিকানায় পৌঁছাতে পারবে না। ঠিকানাহীন বেওয়ারিশ লাশের ঘর অথবা কবরের নৈঃশব্দ্য অন্ধকারই হবে তাঁদের ঠিকানা। অধর চন্দ্র স্কুলের দেয়ালজুড়ে রেশমা বেগম, লিমা আক্তার, রহিমা বেগম, আশরাফুল ইসলাম, সাইদুর রহমান, মমিনুল ইসলাম—কত মানুষের নাম, ঠিকানা, ছবি, কান্নাকাটি, আহাজারি—সবকিছু একাকার হয়ে মিশে আছে।

এনাম মেডিকেল কলেজ সাভার ট্র্যাজেডির দুঃসহ ভার বহন করছে। ১১ তলা ভবনের ৮ তলা পর্যন্ত প্রতিটি ওয়ার্ডে রোগীদের আর্তচিৎকার, আহাজারি, একটুখানি বেঁচে থাকার প্রাণান্ত চেষ্টা। এই হাসপাতালের ডাক্তার, নার্স, শিক্ষার্থী—কারও সঙ্গে কথা বলার সুযোগ নেই। তাঁরা ওপর-নিচ, ৩ থেকে ৫ নম্বর ওয়ার্ড, আবার ৫ থেকে ৯ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসার কাজে ছোটাছুটি করছেন। চতুর্থ তলার লেকচার হলে মানুষ দিয়ে যাচ্ছে পানি, বিস্কুট, পাউরুটি—যাবতীয় শুকনা খাবার। চতুর্থ বর্ষের ছাত্র আতিকুর রহমান বলেন, সেবা-শুশ্রূষায় কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। হাসপাতালের স্টাফ আইরিন ও নুরুননাহার বললেন, এক হাজারের অধিক রোগী তাঁদের হাসপাতাল থেকে এ পর্যন্ত সেবা নিয়েছেন। জানতে চাইলাম, আপনাদের কষ্ট হচ্ছে? বললেন, মানুষকে সেবা করার আনন্দই আলাদা। ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অনেকের পরিচয় মিলছে না। এখানে ১৬ জনকে চিকিৎসা নিতে দেখা গেল। প্রতি মুহূর্তে জীবনকে ধরে রাখার প্রাণান্ত চেষ্টা করছেন এই মানুষগুলো। তাঁরা কেউ জানেন না, এ সংগ্রামের শেষ কোথায়। এই মানুষগুলো সুস্থ হলেও তাঁদের অনেকেই হয়তো স্বাভাবিক জীবনে আর কোনো দিন ফিরে আসতে পারবেন না। জীবনই হবে তাঁদের জীবনের যন্ত্রণা।

অনেকে প্রিয়জনকে জীবিত পাওয়ার আশা করছেন। তাঁরা এনাম হাসপাতালে ভিড় করছেন। প্রিয়জনকে না পেয়ে তাঁদের ছবি, ঠিকানাসহ অপেক্ষা করছেন হাসপাতালের সামনের রাস্তায়। হাতে ছবি ও ঠিকানা নিয়ে শত শত মানুষ রাস্তায় অপেক্ষা করছেন। চলাচল নির্বিঘ্ন রাখার জন্য কাজ করছেন স্বেচ্ছাসেবকেরা। এই মানুষগুলোর যেন ক্লান্তি নেই। কমলার স্বামী তাঁকে খুব কষ্ট দিতেন। বোনের ভালো কাপড় নেই। স্বর্ণ নয়, স্বর্ণের মতো চকচকে চুড়ি। গলার হার কত কী, সে কিনতে চায়। বোনের কষ্ট সহ্য হয় না হাসানের। নিজের কাছে এনেছে সবকিছু কিনে দেবে বলে। ‘আমার ভাইকে এনে দাও, ভাইকে এনে দাও’—কমলার চিৎকারে আকাশ-বাতাস ভেঙে পড়ছে। একমাত্র ছেলের জন্য মা এ-ঘর থেকে ও-ঘরে, আমতলা, কুয়ার পাড়ে পাগলের মতো ছোটাছুটি করছেন। কান্নাকাটি করছেন। এক স্বামী স্ত্রী ছাড়া ঘরে ফিরতে পারছেন না। তাঁদের একমাত্র সন্তান ‘মা মা’ বলে কাঁদছে। রাতে সন্তানের ঘুম নেই। দিনে খাওয়া নেই। কেবল ‘মা মা’। মা বলেছিলেন, রাতে বাসায় আসবেন। রাত, দিন পার হয়ে গেলেও মা ফিরছেন না। বাবা ঘরে গেলেই ‘মা কই, মা কই’ বলে সন্তান চিৎকার করছে। ছোট্ট সন্তান এখনো বুঝতে পারছে না, তার মা হয়তো আর কোনো দিন ফিরে আসবেন না। একটু বেঁচে থাকার আশায় এই মানুষগুলো কাজ নিয়েছিলেন পোশাক কারখানায়। পাবনা, নওগাঁ, ঝিনাইদহ, বরিশাল, যশোর, খুলনা—বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ আহাজারি করছেন। দেশের প্রায় সব জায়গার মানুষ এখানে কাজ করতেন। গোটা দেশটাকে শোকের চাদরে ঢেকে দিয়েছে রানা প্লাজা। আর কত কাঁদলে, কত চিৎকার করলে, কত অপেক্ষা করলে প্রিয়জন ফিরে আসবেন, তা তাঁরা জানেন না।

কেউ জানে না, রানা প্লাজার অন্ধকার গহ্বরে কত মানুষ জীবিত বা মৃত আছে। ভেতরে কবরের অন্ধকার। এর মধ্যেও হয়তো একটু একটু করে রয়েছে জীবনের সম্ভাবনা।

মৃত্যু আগেই জানান দিয়েছিল। তার পরও কেন তাঁদের মরতে বাধ্য করা হলো? এ প্রশ্নের উত্তর কে দেবে, জানা নেই। ফিনিক্স, স্পেকট্রাম, তাজরীন, রানা প্লাজা—এগুলো মানুষ হত্যার স্বাক্ষর বহন করছে। এদের বিচার হওয়ার খবর কারও জানা নেই। আমরা হয়তো আরও বড় কোনো দুর্ঘটনায় সব ভুলে যাব। কিন্তু যাঁরা প্রিয়জনকে হারিয়েছেন? তাঁদের আহাজারি কি কোনো দিন থেমে যাবে? আমরা দেখেছি, প্রিয়জনের লাশ পাওয়ার জন্য কী উদ্বেগ–উৎকণ্ঠা!

রানা প্লাজায় কান পাতলে এখনো হয়তো শোনা যায় মানুষের বাঁচার আকুতি। যাঁরা মৃত্যুকূপ থেকে ফিরে আসছেন, তাঁরা কথা বলছেন বিস্ময়ভরা চোখের অভিব্যক্তিতে। হয়তো পুনর্জন্মের কথা শুনেছেন। কখনো ভেবেছেন? তাঁদের নিজেদেরও একদিন নতুন জন্ম হবে। অচেনা মৃত্যুকূপ থেকে ফিরে এসেছেন। অথচ এই পৃথিবীকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। এ যেন অচেনা পৃথিবীর দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকছেন। পৃথিবীকে মনে হচ্ছে অচেনা। জীবন কী, বেঁচে থাকা কী, তাঁদের থেকে আর কেউ ভালো জানেন না। রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপের নিচে ছড়ানো-ছিটানো থালাবাসন জীবনের আয়োজনের কথা মনে করিয়ে দেয়। যে জীবনের জন্য এত আয়োজন, তাঁরা আর মাটির পৃথিবীতে ফিরে আসবেন না। ধ্বংসস্তূপের গভীর অন্ধকার থেকে হয়তো কেউ ‘বাঁচাও বাঁচাও’ বলে চিৎকার করছেন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কিছু মানুষ মানবতার সেবায় এগিয়ে যাচ্ছেন। এখানে রাত–দিনের পার্থক্য হারিয়ে গেছে। বিভিন্ন সংস্থা ২৪ ঘণ্টা কাজ করছে। বিপন্ন মানুষের পাশে প্রথম দাঁড়িয়েছেন সাধারণ মানুষ। বড় বিপর্যয়ে সাধারণ মানুষই প্রথম মানুষের পাশে দাঁড়ান। আইলা, সিডরসহ সব দুর্যোগে এই সাধারণ মানুষকে আমরা দেখেছি প্রথম সারিতে।

এত বড় বিপর্যয়ে এত মানুষ বেঁচে যাওয়ার ঘটনা যেমন বিরল, তেমনি এত মানুষের মৃত্যুও বিরল। এভাবে ঘর থেকে ডেকে এনে হত্যার ঘটনাও বিরল। বাংলার মাটিতে কেন বারবার ফিরে আসে বিরল সব ঘটনা। ২৭ এপ্রিলের প্রথম আলোয় কবি, সাংবাদিক সোহরাব ভাই লিখেছেন, এ যেন হীরক রাজার দেশ। সব সম্ভবের দেশ। সত্যিই তাই।

লেখক: সাংবাদিক ও সংগঠক