উপলব্ধি

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

বিরতির পরপরই ইমরান সাহেবের ক্লাস। ঘণ্টা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই হাতে বই ও মার্কার নিয়ে শ্রেণিকক্ষে ঢুকলেন তিনি। ক্লাসে সবার দিকে চোখ বুলাতেই তিনি বুঝতে পারলেন আজকে ক্লাসে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী উপস্থিত। সঙ্গে সঙ্গে একটি বিষয় মাথায় খেলে গেল ইমরান সাহেবের। ক্লাসে আলোচ্য পাঠ্যবিষয়ে কিছু সময় আলোচনা শেষ করে সবাইকে বই বন্ধ করতে বললেন এবং ঘোষণা দিলেন, ‘আজ তোমাদের একটি বিষয়ে লিখতে হবে, তবে বিষয়টি একান্তই নিজের।’
এই কথা শুনে ক্লাসের সবাই খুব উদগ্রীব হয়ে উঠল, লিখতে হবে এটা স্বাভাবিক। নিজের সম্পর্কে স্যার কী লিখতে বলবেন, এই চিন্তা অনেকের মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল!
ইমরান সাহেব সবাইকে খাতা থেকে একটি কাগজ ছিঁড়ে নিতে বললেন, সবাই স্যারের কথা অনুযায়ী কাগজ ছিঁড়ে নিল। স্যার নিয়ম বলে দিলেন, কেউ কাগজে নিজের নাম লিখবে না, লেখা শেষ করে ভাঁজ করে সব একত্রে জমা দেবে। সবাই ভাবনায় পড়ে গেল! স্যার কোন বিষয়ে লিখতে বলতে পারেন, এই বিষয়ের অপেক্ষায় শিক্ষার্থীরা। উৎসুক তাদের চোখমুখ। আজ পর্যন্ত এমন পরিস্থিতিতে কখনো তারা পড়েনি, কোন বিষয়ে স্যার লিখতে বলবেন, এ নিয়ে কথা বলছে কেউ কেউ।
অতঃপর স্যার বললেন, ‘আমাদের প্রত্যেকের মনে কিছু কষ্ট লুকায়িত থাকে, যা হাসির অন্তরালে চাপা পড়ে থাকে। আজ তোমরা নিজেদের সেই দুঃখবোধের কথা লিখবে।

সবাই থমকে গেল! ক্লাসে তখন কোনো হইচই নেই, কেউ কোনো কথা বলছে না, সবাই আনমনে নিজের মনের কষ্টের কথা লিখছে, লিখতে লিখতে কারও চোখ ভিজে উঠল, নির্দিষ্ট সময়ে সবাই লেখা শেষ করে, তা জমা দিল স্যারের কাছে। স্যার কাগজগুলো এলোমেলো করে, ক্লাসে সবার মধ্যে কাগজগুলো বিতরণ করলেন। প্রত্যেকের হাতে একটি কাগজ, যাতে দুঃখবোধের কথা লেখা, তবে সেই দুঃখবোধ নিজের নয়, অন্যের। স্যার সবাইকে কাগজ খুলে পড়তে বললেন। সবাই পাঠ করতে শুরু করল, প্রত্যেকের লেখায় ফুটে উঠল নিজের দুঃখের কথা। কারও বাবা হারানোর ব্যথা, কারও মা না থাকার কথা, কারও অপ্রাপ্তির কষ্টের কথা, কারও পরীক্ষায় ফল ভালো না হওয়ায় মন খারাপের কথা, কারও প্রিয়জনকে হারানোর কথা, কারও স্বপ্ন পূরণ না হওয়ার কথা, কারও জীবনের আকস্মিক ঝড়ের কথা। এই কথাগুলোই ফুটে উঠেছিল প্রত্যেকের লেখায়। স্যার প্রতিটি কাগজ আবার জমা করে একত্র করতে বললেন।

স্যার বললেন, ‘আমাদের প্রত্যেকের জীবনেই দুঃখবোধ আছে, সুখ–দুঃখ, আনন্দ–বেদনার সংমিশ্রণেই আমাদের জীবন! কিন্তু সত্যি কি জানো? আমরা মনে করি দুঃখ বুঝি শুধু আমাদের নিজেদের জীবনেই আছে, অন্যদের নেই। অথচ আমাদের সবার মনেই দুঃখ লুকায়িত থাকে। কেউ বুঝতে পারে না! বুঝতে পারে না হাসির আড়ালে কত দুঃখ চাপা পড়ে। আমাদের দুঃখবোধগুলো যখন আমরা একা থাকি, সেই সময়ে আমাদের কুরে কুরে খায়। অস্বস্তিকর করে তোলে আমাদের চারপাশ। অথচ আমাদের প্রত্যেকের জীবনেই দুঃখ আছে। এ কথাটি বোঝাতেই আজকের এই খেলা। সামান্য মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তনেই আমরা ভালো থাকতে পারি! সব দুঃখবোধকে আড়াল করে, মানুষ বেঁচে থাকে। বেঁচে থাকতে হয়—এটাই আজ তোমাদের উপলব্ধি!
কথাগুলো বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেলেন স্যার। সঙ্গে সঙ্গে বাইরে বেজে উঠল বিদায়ের ঘণ্টা!