ইরাবতী পরি ও বাঁশিওয়ালা বকুল

প্রতীকী ছবি

মধ্যদুপুরের প্রখর রৌদ্র। জনশূন্য বিশাল মাঠ। মাঠের মধ্যে একটা প্রকাণ্ড হিজলগাছ। রোদের উত্তাপে ক্লান্ত বকুল। শরীর জুড়িয়ে নেওয়ার জন্য বাঁশিতে সুর তুলেছে। জনশূন্য মাঠের দিক থেকে দিগন্তে ছড়িয়ে পড়ছে সেই সুর। বকুলের বাঁশিতে জাদুমাখা মায়া আছে। সুরের ঢেউ খেলে যায় চারপাশে। ছোটবেলা থেকেই মাঠে মাঠে গরু চড়ায় বকুল। খুব ভালো বাঁশি বাজায় বলে সবাই তাকে রাখাল না বলে বাঁশিওয়ালা বকুল বলে ডাকে। মাথায় সব সময় গামছা বাঁধা থাকে। এক হাতে থাকে মুরলী বাঁশের বাঁশি, অন্য হাতে থাকে পাচনি। ক্লান্ত হলে বাঁশিতে মায়াবী সুর তুলে শরীর-মন জুড়ায়। কখনো কখনো বাঁশির সুরে গরু-বাছুর ডাকে।

ভরদুপুরে অথবা নিশিরাতে একা একা বাঁশি বাজাতে বারণ আছে। বকুল যার কাছ থেকে বাঁশি বাজানো শিখেছে, সেই ওস্তাদ তাকে নিষেধ করে দিয়েছেন। কিন্তু তিনি ব্যাপারটা পরিষ্কার করে বলেননি। তবে বকুল বহুজনের কাছ থেকে শুনেছে, নির্জন মধ্যদুপুরে অথবা নিশিরাতে বাঁশি বাজালে পরি নেমে আসতে পারে। সে পরি ভালো হতে পারে, আবার তার ক্ষতিও করতে পারে। বকুলও সে কথা আগে থেকেই জানত। তবু ক্লান্ত দুপুরে খুবই মন চাচ্ছে, তাই একমনে বাজিয়েই যাচ্ছে।

বকুল বাঁশি বাজাতে বাজাতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে তার চোখ বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম। কিন্তু বাঁশি বাজানো বন্ধ করছে না। কোনো একটা মোহ যেন তাকে চেপে ধরেছে। এমন সময় তাকে চমকে দিল অদ্ভুত এক কিন্নরকণ্ঠী নারী। ‘বন্ধ করো, এই ঐন্দ্রজালিক সুর! এই সুর তুমি কোথায় পেলে? আমি সুরের জালে আটকা পড়ে গেছি। এই নির্জন প্রান্তর দিয়ে আমি গোকুল নগর যাচ্ছিলাম। আমি যেতে পারছি না। এই সুর বন্ধ করো!’ আচমকা এমন কথা শুনে বকুল প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেল। কিন্তু বাঁশির সুর ছাড়ছে না। বকুল বুঝতে পারে, যদি পরি তার বশে না আসে, তাহলে তার বড় ধরনের ক্ষতি করতে পারে।

বকুল সব শক্তি দিয়ে আরও উচ্চ সুরে বাঁশি বাজাতে লাগল। পরি এবার অনেকটা নমনীয় স্বরে বলল, ‘দয়া করে বন্ধ করো তোমার এই মোহনীয় সুর। কথা দিচ্ছি, আমি তোমার কোনো ক্ষতি করব না। তোমার বাঁশির এমন ঐন্দ্রজালিক সুরে আমি বিমুগ্ধ। তোমার সুরের জালে আটকে গেছি আমি। তুমি আমাকে অবমুক্ত করো। কথা দিলাম, আমি ইরাবতী পরি, তোমার ডাকে আবার আসব। তুমি গোকুল নগরের ছাতিমগাছের তলায় নির্জন নিশিতে বাঁশিতে এই ঐন্দ্রজালিক সুর তুলো, আমি অবশ্যই আসব। তুমি যা চাইবে, আমি তা–ই দেব। এখন আমার কাছে এই হীরার অঙ্গুরিটাই আছে, তা-ই তোমাকে দিলাম।’ ইরাবতী পরির কথা শুনে বকুলের মায়া হলো। আশ্বস্ত হলো যে ইরাবতী পরি তার কোনো ক্ষতি করবে না। কথামতো বকুল বাঁশি বাজানো বন্ধ করে দিল। ইরাবতী পরি এক ঝটকায় আকাশে মিলিয়ে গেল।

বকুলের মনে হচ্ছে, সে সবেমাত্র ঘুম থেকে উঠেছে। তাহলে কি সে এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিল? কিন্তু হাতে যে হীরার আংটি, সেটা কোথা থেকে এল? রাজকন্যার মতো সুদর্শন ইরাবতী পরির কথা মনে পড়তেই বকুল মুচকি হেসে মনে মনে বলে, ‘ইরাবতী, তুমি তাহলে আমার বশ মেনে গেছ। আমি নির্জন নিশিতে তোমার গোকুল নগরে আসব। আবার ঐন্দ্রজালিক সুরে বাঁশি বাজাব। আমি জানি, তুমি আসবে ইরাবতী। কারণ, পরিরা কখনো মিথ্যা বলে না।’

তেজগাঁও, ঢাকা।