ইরা ও নীরা

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

ইরা আর নীরা যমজ দুই বোন। এবার দুজনই তৃতীয় শ্রেণিতে উঠেছে। তৃতীয় শ্রেণিতে উঠলে কী হবে, নতুন শ্রেণিতে উঠে তাদের স্কুলে যাওয়া হয়নি। প্রায় দেড় বছর করোনার কারণে স্কুল বন্ধ। ইরা আর নীরা থাকে মিরপুরে। একটি ভালো স্কুলে পড়েও কোনো ক্লাস করতে পারল না, দুই বোন সে দুঃখে কাতর। এ দেড় বছর ধরে ঘরে বন্দী। কোথাও যাওয়া হয় না করোনার জন্য। তা ছাড়া বাবা একটি বড় কোম্পানিতে চাকরি করেন। তেমন ছুটি পান না বাবা, তাই কোথাও আর যাওয়া হয় না।

এখন শরৎকাল। বাবা গ্রামের গল্প করেন। তার শৈশব কেটেছে গ্রামে। এ জন্য বাবা খুব গর্ববোধ করেন। দুই বোন মনোযোগ দিয়ে শোনে বাবার কথা। তার কথার মধ্যে দুজন স্বপ্নে ঘুরে বেড়ায় অচেনা একটি গ্রামের পথ ধরে। বাবা লক্ষ করেন তাদের মনের অবস্থা। বাবা এনাম সাহেব কথা দিয়েছিলেন, ইরা আর নীরাকে গ্রামে নিয়ে যাবেন বেড়াতে। শরৎকালে গ্রামের বিলে ফোটে লাল আর সাদা শাপলা।

এক সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফিরে বাবা বলেন, ‘কাল গ্রামের বাড়ি যাব। খুব সকালে ঘুম থেকে উঠতে হবে সবাইকে।’ দুই বোন লাফিয়ে ওঠে হইহই করে।

সকাল সাতটার মধ্যে গাড়ি নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়েন। ড্রাইভারকে সময়ের কথা আগেই বলা হয়েছিল। গাড়িতে উঠে দুজনের সে কী আনন্দ! এই প্রথম তাদের গ্রামে যাওয়া। এর আগে একবার গিয়েছিল, তখন তারা খুব ছোট ছিল, কিছুই মনে নেই।

গাড়ি শোঁ শোঁ করে বুড়িগঙ্গা ব্রিজ পার হয়ে সামনে এগিয়ে চলছে। বাবা তাদের রাস্তার দুই পাশের বাড়িঘর দেখান আর বলেন, পদ্মা ব্রিজ হওয়াতে এখানকার রোড সব পাল্টে গেছে। কেরানীগঞ্জ জেলখানা পার হতে রাস্তার অবস্থা দেখে ইরা বাবাকে বলে, ‘এখানে এসে মনে হয় না এটা আমাদের দেশ!’ এনাম সাহেব বলেন, পদ্মা ব্রিজ হওয়াতে এ রাস্তা এত সুন্দর হয়েছে।

গাড়ি মুহূর্তের মধ্যে মাওয়ায় চলে আসে। খুব কাছ থেকে পদ্মা ব্রিজ দেখে দুই বোন আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায়। এত দিন তারা শুধু টিভিতে দেখেছে, আজ পদ্মা ব্রিজের সামনে এসে নিজের চোখে দেখতে পাচ্ছে। বান্ধবীদের কাছে গল্প করা যাবে, তারা পদ্মা ব্রিজ কাছ থেকে দেখে এসেছে। বাবা ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বলেন। গাড়ি রাস্তারে এক পাশে রাখেন। গাড়িতে বসে কিছুক্ষণ ব্রিজ দেখেন। মোবাইলে ছবি তুলে দুই বোন। আবার গাড়ি চলতে থাকে সামনের দিকে।

দুই বোন বাবা–মায়ের সঙ্গে গল্প করতে করতে তাদের গ্রামের বাড়িতে এসে গাড়ি থামে। গাড়ি থেকে সবাই নেমে পড়ে। বাড়ি দেখে অবাক হয়, তাদের কত বড় বাড়ি। বাড়ির মধ্যে কত ধরনের ফলের গাছ। সব গাছ না চিনলেও আম, নারকেল, বেল, জাম্বুরা, লিচুগাছ চিনতে পারে। আর যেসব গাছ চিনতে কষ্ট হয়, বাবার কাছ থেকে জেনে নেয়। গাছের ডালে নানা জাতের পাখি ডাকছে। গাছের ছায়াতে হাঁটতে দুজনের খুব ভালো লাগছে। বাড়ির পূর্ব পাশে আসতে চোখে পড়ে বিশাল বিল। বিলের মধ্যে ফুটে আছে বিভিন্ন ধরনের শাপলা ফুল। দুজনই চিৎকার করে ওঠে মা মা করে। মা জোবেদা দৌড়ে আসেন তাদের কাছে। মা কাছে আসতেই আবদার করে শাপলা তুলতে যাব।

বাবা একটা নৌকার ব্যবস্থা করে তাদের নিয়ে বিলের মধ্যে চলে আসেন। লাল–সাদা শাপলা ফুটে আছে। ইরা আর নীরা নৌকার কিনারে বসে শাপলা তুলে নৌকার মেঝেতে রাখে। বাবা বলেন, ‘সাবধানে শাপলা তোলো, এখানে অনেক পানি। আরেকবার এলে তোমাদের সাঁতার শেখাবে মিলন কাকা।’ দুজনে রাজি হয়। তারা অনেকক্ষণ বিলের মধ্যে ঘুরে বেড়ায়। বিলের পানিতে নানা ধরনের পাখি সাঁতার কাটছে। মিলন কাকা শাপলা আঁটি বেঁধে বাড়ির ঘাটলার কাছে বেঁধে রাখেন। শাপলা ফুলগুলো পানিতে ভেসে আছে, দেখতে খুব ভালো লাগছে।

একসময় সন্ধ্যা হয়ে আসে। বাবা গাড়িতে ওঠার জন্য সবাইকে তাড়া দেন। ইরা আর নীরা থাকতে চেয়েছিল গ্রামে। বাবা বলেন, ‘আগামীকাল তোমাদের স্কুল খুলবে অনেক দিন পর।’
ইরা ও নীরা মলিনমুখে গাড়ির দিকে পা বাড়ায়।

লৌহজং, মুন্সীগঞ্জ