আশাশুনি

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

শরৎ শুরু হয়েছে। সেদিন সন্ধ্যায় রামপুরা থেকে বনশ্রী যাওয়ার পথে বৃষ্টি ছটা দেখে মনে হলো, প্রকৃতিতে এখনো ঋতু বর্ষার মাস শ্রাবণের ঘোর কাটেনি। ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মধ্যেই রিকশায় উঠে চালকের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। নাম আবু মুসা। বয়স ষাটের কাছাকাছি। মুখজুড়ে কাঁচা–পাকা দাঁড়ি। দেখতে প্রায় পিতার বয়সী। বললাম, ‘মুখে মাস্ক দেন না কেন, চাচা? কাপড়ের দু–তিনটা মাস্ক কিনে নেবেন। অল্প দামে পথেই পাওয়া যায়। ধুয়ে আবার ব্যবহার করবেন।’

আবু মুসা বললেন, ‘সিটের নিচেই আছে। মুখে দিয়েও রাখতে পারি না, বাজান। শ্বাস নিতে বড় কষ্ট হয়।’ ভালো করে তাকাই। পরিশ্রমী শক্ত-সামর্থ্য দেহাবয়ব। কিন্তু চেহারায় করাল বার্ধক্যের ছাপ। অমানুষিক শ্রম-ঘামের চিহ্ন। জীবনের খরস্রোতা নদীতে হঠাৎ চর পড়ে গেছে যেন। হু হু করে ওঠে বুকটা। এ বয়সে পেডল ঘুরালে এমনিতেই কষ্ট হওয়ার কথা। মেডিকেল সায়ন্সের জ্ঞানগর্ভ আলোচনার গলিঘুপচিতে পা বাড়াতে আর ইচ্ছা করে না। কখনো বিশ্বাস ও চর্চা বড়ই ব্যক্তিগত, নৈর্ব্যক্তিক ও আপেক্ষিক। জ্ঞান বিতরণ করাই যায় কিন্তু তা নিয়ে জোরাজুরি চলে না। যথারীতি ভেবেছিলাম, বাড়ি নিশ্চয়ই উত্তরবঙ্গের কোথাও হবে। কিন্তু গলার স্বর শুনে তা আর মনে হলো না। বয়সে প্রবীণ এ রিকশাচালকের বাড়ি দক্ষিণ জনপদ সাতক্ষীরা জেলার আশাশুনিতে।

কী সুন্দর নাম—আশাশুনি। কিন্তু সেখানে এ মুহূর্তে আশা নেই, স্বপ্ন নেই। জানালেন, মানুষ বরং বড় অসহায়। কাঁদছে। বর্ষা মৌসুমে জোয়ারের জলে তাদের বাড়িঘর ডুবে আছে। বর্ষা মৌসুম শেষ হলেই পানি নামবে। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দেয়াল হয়ে থাকা সুন্দরবন তাদের বেঁচে থাকার অনন্ত আশ্রয়, তা বাংলাদেশকে যেমন আগলে রাখে, তেমনি উপার্জনের আধার হয়ে স্থানীয় লোকজনকেও অনাদিকাল থেকে মমতায় আগলে রেখেছে। সেখানে এ মুহূর্তে মাছ ধরায় বিধিনিষেধ আছে বলে নিরুপায় হয়ে ঢাকা শহরে আসা। এ মুহূর্তে তিন চাকার রিকশাই বেঁচে থাকার সম্বল। একসময় বর্ষায় ভাটির ‘বারকি নাও’ বাওয়া শ্রমিকদের মতো খেপের জীবন। জানালেন, কয়েক দিন পরেই বিধিনিষেধ উঠে গেলে আবার এলাকায় ফিরবেন। নগরের হুজ্জতের চেয়ে সুন্দরবনের জঙ্গলেই তাদের মঙ্গল। ২০ বছর ধরে মাছ ধরছেন সেখানে।

মৌয়াল হয়ে মধু আহরণও করেছেন। আগ্রহী শ্রোতা পেয়ে—বাঘের মুখে পড়ে লড়াই করেছেন—এমন গল্প অবশ্য জাহির করেননি। তবে জানালেন, অনেকবারই বাঘ দেখেছেন। নদীতে, সুন্দরী ও কেওড়া বনের খালে—জল ভেঙে রাজকীয় ভঙ্গিতে পেরিয়ে যেতে। সুন্দরবন অঞ্চলের মানুষ বাঘকে ‘বাঘ’ বলে ডাকে না। বাঘের ভয় ছাড়াও আছে ঝড়–জলোচ্ছ্বাসের ভয়। অনেকবারই ঝড়ের কবলে পড়েছেন। সরু খালে ট্রলার ঢুকিয়ে ওপরওয়ালার নাম নিয়েছেন অনবরত। অথই নদীতে একবার ঝড় উঠলে মরতে মরতে বেঁচেও গেছেন দু–একবার। তবে হারিয়েছেন সঙ্গী-সাথিকে। আহা! কত বিচিত্র জীবন। কাছে যাই না বলে জানা হয় না। কারও অন্তরের কাছে গভীরভাবে পৌঁছাতে পারলেই মানুষ তার গল্প বলতে শুরু করে। একান্ত দুঃখবোধ সঙ্গী করে যতবার আমি গল্প শুনতে গেছি, ততবারই গল্পের মানুষের অন্তর্গত দুঃখ ছুঁয়ে লজ্জা পেয়েছি। চেনা দুঃখবোধের চেয়ে কত প্রগাঢ় তাদের দুঃখবোধ।

জীবন থেকে নেওয়া গল্পের ফাঁকে জানালেন ট্রলার নিয়ে সুন্দরবনে গেলে নির্বিঘ্নে মাছ ধরতে চাইলে নাকি প্রতি ট্রিপে বনের দস্যুদের ১০ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়। না হলে জেলেদের ধরে নিয়ে যায়। একজনের মুক্তিপণে তখন ৮০ থেকে ১ লাখ টাকা গোনা লাগে। বললাম, ‘চাচা, ঢাকায় বসে তো শুনি, ডাকাতদের আগের মতো আর উপদ্রব নেই। সবাই নাকি আত্মসমর্পণ করেছে।’ তিনি প্রত্যুত্তরে বলেন, ‘ঢাকার মানুষ কি আর বনে গিয়ে সেসব দেখে, বাজান।’ তাই-তো। টিভিতে, পত্রিকায় সুন্দর প্রতিবেদন। এসবই সান্ত্বনা। বাঘ ছাড়াও সুন্দরবনের হরিণ, গাছ, বন্য প্রাণী যাদের রক্ষা করার কথা, তারাই প্রায় শিকার করে খায়। এভাবে চিরকালই রক্ষক ভক্ষক হয়ে ওঠে। গন্তব্যে পৌঁছানোর পূর্বে বলি, ‘চাচা, আশাশুনি বাড়ি। আশার গল্প বলেন। এ বড় দুঃখের সময়, নিরাশার কাল।’

তিনি বলেন, ‘বাবা তিনটা মেয়ে ছিল। বিয়ে দিছি। একটা ছেলে আছে। এলাকার কলেজে বিএ পড়ে। ওই ছেলেই এ মুহূর্তে আমার আশা।’ ছেলে কি তা জানে? জীবন কি বয়োবৃদ্ধ মানুষটাকে আশা পূরণের সে অবসরটুকু দেবে আশা, স্বপ্ন ও সম্ভাবনার কাছে পৌঁছানোর? তবু তো জীবনভর মানুষ আশার স্বপ্ন বোনে। ‘যে জীবন ফড়িংয়ের দোয়েলের—মানুষের সাথে তার হয় নাকো দেখা।’ হয় না? কে জানে।