আলোর ফুলকি অবন ঠাকুর

শিল্পী, লেখক, নন্দনতত্ত্ববিদ অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর (৭ আগস্ট ১৮৭১- ৫ ডিসেম্বর ১৯৫১)
ছবি: সংগৃহীত

‘সেই সময়ে কলকাতায় লাগল প্লেগ। চারদিকে মহামারী চলছে, ঘরে ঘরে লোক মরে শেষ হয়ে যাচ্ছে। রবিকাকা এবং আমরা এ বাড়ির সবাই মিলে চাঁদা তুলে প্লেগ হাসপাতাল খুলেছি, চুন বিলি করছি। রবিকাকা ও সিস্টার নিবেদিতা পাড়ায় পাড়ায় ইন্সপেকশনে যেতেন। নার্স ডাক্তার সব রাখা হয়েছিল।’
(অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘জোড়াসাঁকোর ধারে’)
আজ বৈশ্বিক করোনা মহামারির কালে আমাদের দুঃসহ দিনরাত্রি যাপনের কালে যখন আমরা অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্ধশত জন্মবার্ষিকী উদ্‌যাপন করছি, তখন অবন ঠাকুরের স্মৃতির পাতায় চোখ বোলালেও দেখি মহামারির কালে কী করে তাঁর প্রিয় রবিকাকার (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর) সঙ্গে মিলে মহামারিতে বিপর্যস্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। আজও আমাদের বহু স্বেচ্ছাসেবী ছেলেমেয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এই কাজ করে যাচ্ছেন। তাঁদের সবার ভেতরই আছে রবি ও অবন ঠাকুরের মতো আলোর ফুলকি; যে আলোর ফোয়ারা মানুষকে মানুষের পাশে দাঁড়াতে শেখায়, মরণশীল মানবজন্মকে দান করে জয়ী জীবন।

আজ থেকে ১৫০ বছর আগে, ১৮৭১ সালের ৭ আগস্ট কলকাতার আলোকদীপ্ত ঠাকুর পরিবারে জন্ম হয় অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। রবীন্দ্রনাথের জ্ঞাতিভাই গুণেন্দ্রনাথ ও সৌদামিনী দেবীর পুত্র অবন ঠাকুর কাকা রবীন্দ্রনাথের চেয়ে ছিলেন মাত্র ১০ বছরের ছোট। আবার কী আশ্চর্য, তিনি পৃথিবী ছেড়ে চলেও যান রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণের ঠিক ১০ বছর পরে ১৯৫১ সালের ৫ ডিসেম্বর।
৮০ বছরের জীবনটা ভরা ছিল আঁকা, লেখা, শিক্ষকতা ও স্বাদেশিকতায়। আর এসবের নেপথ্যে ছিল হৃদয়-আকাশে জ্বলজ্বল করা স্বপ্নতারার প্ররোচনা। ‘আর্টিস্ট’ বলে আলাদা কোনো প্রদেশে তাঁকে আবদ্ধ করা যাবে না। আবার শুধু ‘লেখক’ বলে চিহ্নিত করলে ভুল হবে। তিনি তো সেই ‘ওবিন ঠাকুর’, যিনি ‘ছবি লেখেন’। তাঁর আঁকা ‘কৃষ্ণলীলা’, ‘কচ ও দেবযানী’, ‘ভারতমাতা’, ‘শুক্লাভিসার’, ‘বুদ্ধ ও সুজাতা’, ‘ওমর খৈয়াম’-এর মতো চিত্রমালার ভেতর কত যে গল্পতরুর বীজ পোঁতা আছে!
আবার তাঁর লেখা ‘শকুন্তলা’, ‘ক্ষীরের পুতুল’, ‘রাজকাহিনী’, ‘ভূত পত্‌রীর দেশ’, ‘নালক’, ‘বুড়ো আংলা’, ‘আলোর ফুলকি’, ‘মারুতি পুঁথি’র মতো বইপত্রের প্রতিটি অক্ষরে, বাক্যবন্ধে যে চিত্রপট উদ্ভাসিত হয়, তা ছোট–বড় সব বয়সী পাঠককে দেয় অনুপম চিত্রশালা প্রদর্শনীর অভিজ্ঞতা। ‘চিত্রাক্ষর’ নামে অবন ঠাকুরের একটা বই আছে। নামটাই যেন তাঁর আঁকা ও লেখার যথাযথ ব্যাখ্যা।

ঔপনিবেশিক ভারতে পরাধীনতার জোয়ালকে কেউ রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করতে চেয়েছেন, আবার কেউ শিল্প-সংস্কৃতিগতভাবে। অবন ঠাকুরের লড়াইটা ছিল শিল্প আর সংস্কৃতির লড়াই। তাই পাশ্চাত্যের কলাবিদদের কাছে শিল্পশিক্ষা গ্রহণ করে তিনি দেশীয় শিল্পরীতির পুনরুজ্জীবনের প্রয়াস পেয়েছেন। কলকাতার বুকে স্থাপন করেছেন ‘ওরিয়েন্টাল আর্ট সোসাইটি’। ভারতীয় এবং এশীয় চিত্র ঐতিহ্যের প্রতি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চান তিনি। তাঁর স্বতন্ত্র শিল্পচিন্তা যেমন ‘বাগেশ্বরী শিল্প প্রবন্ধাবলী’ নামের বিখ্যাত নন্দনকলার বইতে লিপিবদ্ধ আছে, তেমনি ফেলে দেওয়া জিনিসপত্র থেকে তৈরি ‘কুটুম কাটাম’ নামের বিশেষ শিল্পরীতিতেও ধরা আছে। ‘বাংলার ব্রত’ নামের আর একটা বই আমাদের লোকায়ত ঐতিহ্যের অসামান্য নিদর্শন।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আপন কথা’ ও ‘জোড়াসাঁকোর ধারে’ বইতে যেমন তাঁর এবং ঠাকুর পরিবারের সেই ফেলে আসা সময়কে খুঁজে পাওয়া যায়, তেমনি কবি জসীমউদ্‌দীনের স্মৃতিকথা ‘ঠাকুরবাড়ির আঙিনায়’ বইয়ে অন্তরঙ্গ অবনীন্দ্রনাথকে পাওয়া যায় ‘অবন ঠাকুরের দরবারে’ শীর্ষক অধ্যায়ে।
আমরা তো মনে করি, একজীবনে রবীন্দ্রনাথের হাজারটা কীর্তির মধ্যে অন্যতম তাঁর ভাইপো অবন ঠাকুরকে লেখালেখিতে উদ্বুদ্ধ করা। তিনিই তো অবনকে বলেছিলেন, ‘ছোটদের পড়বার মতো বই বাংলা ভাষায় বিশেষ নেই। এ অভাব আমাদের ঘোচাতে হবে। তুমি লেখ।’

হ্যাঁ, লিখলেন অবন। রবিকাকার আহ্বানে তাঁর আলোর রথ চালালেন আমাদের পাঠকদের মনের মাঠে আর আকাশে। যেমন আকাশে উড়ে বেড়ায় তাঁর কালশ্রেষ্ঠ বই ‘বুড়ো আংলা’র রিদয়। রিদয় আকাশ দিয়ে উড়ে বেড়ায় আর ভাবে, ‘এই আকাশ দিয়ে একেবারে হু–হু করে উড়ে চলায় কি মজা, কত আনন্দ! বাতাসে কোথাও ভিজে মাটির গন্ধ, কোথাও ফোটা-ফুলের খোসবো, কোথাও পাকা ফলের কি মিঠে বাসই আসছে! পৃথিবীর গায়ের বাতাস যে এমন সুগন্ধে ভরা রিদয় আগে তো জানেনি!’
অবন ঠাকুরের কোন লেখাটা ছেড়ে কোনটার কথা বলব আমরা! পৌরাণিক কাহিনি, ধর্মগাথা আর বাংলার বুকে বয়ে চলা লোকগল্পের ধারাকে সম্পূর্ণ নতুন করে চিরকালের পাঠকের সামনে হাজির করেন তিনি। তখন মনে হতে থাকে, আরে, শকুন্তলা তো আমার গ্রামেরই মেয়ে, রিদয় তো আমাদের পাশের পাড়ার ছেলে, ‘ক্ষীরের পুতুল’-এর বুদ্ধিমান বানর তো আমাদের বুকের ভেতরে ঘাঁটি মেরে থাকা ‘পার্সোনাল ইন্টিলিজেন্ট সেল’ আর ‘নালক’ নামের বালক তো তুমুল অন্ধকারে বাস করা আলোতৃষ্ণাকাতর এই আমিই।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা পড়লে বিস্ময় জাগতে থাকে—বাংলা ভাষার নদীতে এত এত রূপজলের ধারা! আমাদের মাতৃভাষা বাংলা কত কত প্রভাতপাখির গান আর কত কত নিশির শিশিরের কাঁচামালে গড়া, তা অবন ঠাকুরের বইয়ের পৃথিবী ঘুরে এলে ঠাহর করা যায়।

‘ক্ষীরের পুতুল’-এ আদরিনী সুওরানী তার জন্য গড়ে দেওয়া সোনার শাড়ি নিয়ে অনুযোগ করায় রাজা যখন উত্তর দেন, তখন যেন কথা নয়, একটি অপূর্ব ছবি আঁকা হতে থাকে আমাদের মানসপটে: ‘রাজা বললেন— আহা, আহা, তাই তো রানী, সোনার আঁচলে সোনার অঙ্গে ছড় লেগেছে, ননীর দেহে ব্যথা বেজেছে। রানী হাসিমুখে বিদায় দাও, আকাশের মতো নীল, বাতাসের মতো ফুরফুরে, জলের মতো চিকন শাড়ি আনিগে।’
কিংবা ‘নালক’-এর সূচনাভাগে গৌতম বুদ্ধের জন্মের আগমনী ক্ষণকে কীভাবে চিত্রাক্ষরে বন্দী করেন তিনি! চলুন, একটু পড়ি:
‘নিশুতিরাতে কালো আকাশে তারা ফুটেছে, বাতাস ঘুমিয়ে আছে, জলে ঢেউ উঠছে না, গাছে পাতা নড়ছে না। এমন সময় অন্ধকারে আলো ফুটল—ফুল যেমন করে ফোটে, চাঁদ যেমন করে ওঠে—একটু, একটু, আরো একটু। সমস্ত পৃথিবী দুলে উঠল—পদ্মপাতার জল যেমন দুলতে থাকে এদিক-সেদিক, এধার-ওধার সে-ধার! ঋষি চোখ মেলে চাইলেন, দেখলেন আকাশে এক আশ্চর্য আলো! চাঁদের আলো নয়, সূর্যের আলো নয়, সমস্ত আলো মিশিয়ে এক আলোর আলো!’

আলোয় গড়া এমন অভূতপূর্ব আলোর আভায় ভাস্বর অবন ঠাকুরের লেখাপত্রের ঘরদুয়ার। আর তাঁর লেখা পড়তে পড়তে যেন তাঁরই মতো কোনো অচিনলোকের দক্ষিণের বারান্দা থেকে আমরা দেখতে পাই এই আশ্চর্যসুন্দর পৃথিবীতে চলতে থাকা তাঁর চিত্র প্রদর্শনী; সেখানে কচ ও দেবযানী, বুদ্ধ ও সুজাতা আর ওমর খৈয়াম—সবাইকে দেখতে পাওয়া যায়। জন্মের ১৫০ পেরিয়েও অবন ঠাকুর পুরোনো হন না! তাই তো তাঁর ‘বুড়ো আংলা’ লেখার বহু বছর পর বাংলাদেশের এক বরেণ্য কথাশিল্পী রশীদ করীম তাঁর ‘আমার যত গ্লানি’ (১৯৭৩) উপন্যাসে ‘বুড়ো আংলা’র রিদয়কে মুক্তিযুদ্ধের রক্তে রঞ্জিত এই বাংলার পবিত্র মাটিতে নিয়ে আসেন এইভাবে:
‘দগ্ধ গ্রাম, বিরান মাঠ, শূন্য কুটির দেখে, আপনি ভাবতেন, রিদয় এ কোন দেশে এসে উপস্থিত হয়েছে। এ রকমটি তো ছিল না। আমরা বলতাম, অবিন ঠাকুর, চিন্তা করবেন না। এই ধ্বংসস্তূপেই এখন দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশ। সেরা দেশ–সোনার দেশ–সবুজ দেশ–ফলন্ত ফুলন্ত বাংলাদেশ। আপনার রিদয় যদি আবার আমাদের দেশে বেড়াতে আসে সেই আশ্চর্য বাংলাদেশকেই সে আবার দেখতে পাবে। আবার আমরা গড়ে নেবো, সেই সোনার দেশ।’
অবন ঠাকুরের রিদয়, তোমাকে স্বাগত সুবর্ণজয়ন্তীর সোনার বাংলাদেশে।