আল রশিদের সালামি

প্রতীকী ছবি
সংগৃহীত

একাল, সেকাল, দিনকাল। ছোটবেলায় এমন কত কালের কথাই না শুনেছি। সবশেষ আমার দাদি বলতেন কলিকাল। এটা বলেই তিনি থেমে যেতেন না; তারপর বলতেন, কলিকালে কত কীই–না দেখব। তিনি আর সেই কত–কী দেখে যেতে পারেননি। কিন্তু আমরা দেখলাম কলিকালের পরে হলো করোনাকাল। একাল বড় দুঃখের কাল। কষ্টের কাল। একালে চাকরি, ব্যবসা, কাজকর্ম—কিছুই থাকে না। নিশিদিন শুধু দুশ্চিন্তা।

এরই মধ্যে হাজির হলো পবিত্র ঈদুল ফিতর। এ জনপদের মানুষ খুব উৎসবপ্রিয়। তারপর বাঙালি মুসলমানের সবচেয়ে বড় উৎসব ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা। যত কষ্টই হোক, তারা এটা পালন করবেই।

একদিন বন্ধুদের আড্ডা হচ্ছিল। আর এই আড্ডাটা তখনই বেশি জমে, যখন আল রশিদ সাহেব থাকেন। ঈদে কে বাড়ি যাবে, যাবে না—এমন প্রসঙ্গ আসতেই তিনি বললেন, কেউ বাড়ি যাবেন না। সবাই মজা করে ঢাকায় ঈদ করব। আমার ওই দাদির মতো তিনি এটা বলেই থেমে গেলেন না; আরও বললেন, সবাইকে তিনি ঈদের সালামি দেবেন।

রশিদ সাহেবের কথা শুনে মনে পড়ল সেই ছোটবেলার কথা। তখন সালামি পেতাম। এটা খুব লোভনীয় ছিল। এ লোভের বাইরে থাকার দুঃসাহস কারও ছিল না। কোনো উৎসব, বিশেষ করে ঈদ এলেই সালামি নিয়ে চিন্তা-দুশ্চিন্তা দুটোই বাড়ত। গভীর রাত জেগে হিসাব করা হতো যে এ বছর কালেকশন কেমন হবে। আমাদের ছোট একটা দল ছিল। এ দলের সদস্য ছিল সালাম, লাবু, মিন্টু, দেলোয়ার ও লিটু। এর শিরোনাম ছিল ‘সালামি দল’।

আমরা গোপন বৈঠক করতাম। কখনো রুফটপ, কখনো ইনহাউস, আবার কখনো বা রুদ্ধদ্বার। কে কত সালামি দিতে পারে, একটা আন্দাজ করতাম। একবারের কথা মনে আছে, সেবার সালামিদাতাদের নিয়ে একটা গোলটেবিল বৈঠক করলাম। আলোচনার এজেন্ডা ঠিক হলো। এজেন্ডার প্রথমে ছিল দাতাদের তালিকা করা। তালিকায় যে সংখ্যা হলো, তাতে কেউ কেউ সন্তুষ্ট হলো না। সদস্য বাড়াতে হবে। খুঁজে খুঁজে তালিকায় আরও নাম বাড়ান হলো।

দেলোয়ার বলল, সবাইকে সমান হারে টাকা দিতে হবে। আরেকজন বলল, না দিলে কী হবে। যারা দেবে না, তাদের ওপর জুলুম হবে। আন্দোলনে নামতে হবে। আন্দোলন ছাড়া এ দেশে কোনো দাবিদাওয়া আদায় হয় না। তখন মিন্টু বলল, সালামির জন্য সন্ত্রাস, জুলুম, আন্দোলন। ভবিষ্যতে ভালো হবে না। এ কথা শুনে লিটু ভীষণ রেগে গেল। সে বলল, এই বেটা আমরা আছি বর্তমানে। তুই এর মধ্যে ভবিষ্যৎ আনলি ক্যান? আমার মনে হইছে তাই আনছি, তোর সমস্যা কী? সমস্যা কী দেখবি বলেই এক ঘুষি। এই নিয়ে হাতাহাতি। খানিকটা চিৎকার–চেঁচামেচি। পরে দুজনকেই শান্ত করা হলো। আর সেদিনের মতো বৈঠক মুলতবি ঘোষণা করা হলো।

পরের দিন আবার বসা হলো। সেদিনের আলোচনায় সালামিদাতাদের দুটো গ্রুপ করা হলো। একটা দানশীল গ্রুপ। একটা কিপটে গ্রুপ। লাবু বলল যে একটা হাড়কিপটে বা ‘ক্যাস্টা গ্রুপ’ করতে হবে। তখন আমাদের অনেকেরই বিশেষ এই গ্রুপ সম্পর্কে ধারণা নেই। আমাদের মধ্যে দেলোয়ার ছিল বেশ অভিজ্ঞ। সে হাড়কিপটে গ্রুপের ইতিহাস, বংশপরিচয়, এদের পূর্বপুরুষ কোথায় ছিল, কীভাবে এ দেশে আগমন ঘটেছে—সবই ব্যাখ্যা করল।

বললাম, এত গ্রুপ করতে গেলে এ প্রকল্প হুমকির মুখে পড়তে পারে। অভিজ্ঞজন বলল যে প্রকল্প বাস্তবায়নে দরকার হলে কর্মশালা করা হবে। খেয়াল রাখতে হবে, ঐক্যে যেন ভাঙন না ধরে। আর শত্রুপক্ষ যেন ঢুকে না পড়ে। সেদিন এমনি এমনি মারামারি হয়নি। বুঝতে হবে, শত্রুপক্ষ ঢুকে পড়েছে। সিরাজউদ্দৌলার পতন হইছিল ক্যামনে? তাঁর দলেই ছিল শত্রুপক্ষ। বঙ্গবন্ধুও তাঁর সাত মার্চের ভাষণে দলে যেন শত্রুপক্ষ না ঢোকে, সে জন্য সবাইকে লক্ষ রাখতে বলেছিলেন। তাই আমাদেরও সবাইকে আরও সতর্ক হতে হবে। যা–ই হোক, সেসব অনেক স্মৃতি। বলে শেষ করা যাবে না।

আশফাকুজ্জামান

এবার আশা যাক রশিদ সাহেবের সালামিতে। যেকোনো উৎসব আর সেটা যদি হয় ঈদ, তাহলে বাড়িতে যাওয়া হয়। রশিদ সাহেব বললেন যে ঢাকায় সবাই মজা করে ঈদ করব, সে জন্য আর বাড়ি যাওয়া হলো না। ছুটিতে ঢাকায় থাকলাম। ঈদও শেষ হলো। মজা কতটুকু হলো বা না হলো, রশিদ সাহেবই ভালো জানেন। আবার শুরু হলো অফিস। অফিসে যাই। খাইদাই, ঘুমাই। আর কী। ঈদের পর সাধারণত কাজের তেমন চাপ থাকে না। সব জায়গায় উপস্থিতিতে ভাটা পড়ে। এরই মধ্যে গেলাম বন্ধুদের আড্ডায়। কেউ নেই, ফাঁকা রুমটায় রশিদ সাহেব একাই বসে আছেন। দেখেই একগাল হাসি। আরে ভাই, আপনার জন্যই আছি। আপনি কেন আসেন না। ভাবখানা এমন যে আমার জন্যই তিনি এখানে আসেন। আমি তো জানি কাজ ছাড়া তিনি এক পাও নড়বেন না। ওই কক্ষে যে–ই ঢুকত, তাকেই তিনি এই সম্ভাষণ করতেন। বললাম, কী যে বলেন ভাই, আপনাকে না দেখে কি এক দিনও থাকা যায়? এক দিন না দেখলে বুকের মধ্যে আনচান করে। মনে মনে ভাবলাম, আবার প্রশ্ন না করে বসেন, তাহলে এত দিন কীভাবে থাকলেন। আসলে তিনি হলেন রিয়েল ভদ্রলোক। আমাকে ধরা খাওয়ানোর জন্য এ প্রশ্ন আর করলেন না।

তারপর অনেক কথা, অনেক গল্প। একপর্যায়ে বললেন, ভাই, আপনাকে যে সালামি পাঠিয়েছি, সে ব্যাপারে তো কিছু বললেন না। বললাম, ভাই, কী সালামি, কিসের সালামি। আমার তো কিছু মনে নেই। কেন, ঈদের আগে বলেছিলাম না। আরে ভাই, আমি সেই পলিটিকস করি না, যারা মানুষকে কথা দিয়ে কথা রাখে না। বললাম, ভাই সরি, এটা আমার মনেও নেই আর তাই দেখাও হয়নি। ভাই, এটা আপনি মোটেই ঠিক করেননি। আপনি বড় ভাই। এত আশা নিয়ে আপনাকে সালামি পাঠিয়েছি। আর আপনি কিনা সেটা দেখলেন না। জানেন ভাই, জীবনে বড় হতে হলে ছোট ছোট বিষয়ও লক্ষ রাখতে হয়। এই যে আমাকে দেখেন, আমি সব বিষয়ে লক্ষ রাখি। আপনাকে এত ভালোবাসি আর আপনি কিনা এত বড় একটা ভুল করলেন! ভাই, সক্রেটিস বলেছিলেন, সে–ই সবচেয়ে বড় দেশ প্রেমিক, যে নিজের কাজ ঠিকভাবে করে। ভাই, নিজের কাজ ঠিকভাবে করেন। নইলে আখেরে পস্তাবেন। আর বাসায় গিয়েই গরিবের অনুরোধটা রাইখেন।

রশিদ সাহেবের কথায় নিজেরও বেশ মন খারাপ হলো। খানিকটা লজ্জাই লাগল। শুধু লজ্জা না, একধরনের অপরাধবোধ হলো। ভাবলাম, ইহজনমে এই অপরাধের ক্ষমা নেই। কিন্তু রাস্তায় নেমেই এক অন্য রকম অনুভূতি হলো। এত দিন রশিদ সাহেবকে মনে মনে পছন্দ করতাম। আর আজ এই প্রথম কারওয়ান বাজার মাথার ওপর খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে, চারদিকে নানা কিসিমের মানুষের ভিড়, চেঁচামেচি, চিৎকার উপেক্ষা করে, নিচে পেঁয়াজ, রসুন, ফলমূল, শাকসবজিকে সাক্ষী রেখে রশিদ সাহেবের জন্য প্রাণখুলে বললাম, ‘জগতের সকল প্রাণীর সঙ্গে তিনি যেন সুখে থাকেন।’

বাসা থেকে অফিসের দূরত্ব খুব বেশি না। পদব্রজেই আশা-যাওয়া। অন্যদিন অন্য কথা ভাবি আর হাঁটি। আজ শুধু সালামির কথা ভাবতে ভাবতেই বাসায় আসা। ভাবলাম, বাসায় ঢুকেই আগে বিকাশ চেক করব। কিন্তু রুমে ঢুকেই ডিসিশন চেঞ্জ করলাম। দেরি যেহেতু হয়েছে, আরেকটু হোক। আগে হাত-মুখ ধুয়ে, খেয়েদেয়ে নিরিবিলি হই। কিন্তু খাওয়ার পর আবারও মত পরিবর্তন করতে হলো। তখন মনে হলো স্ত্রী-পুত্র-কন্যারা ঘুমিয়ে যাক। রাত আরও গভীর হোক চারপাশ আরও নীরব হোক। তারপর চেক করব। প্রিয় পাঠক, এই অপেক্ষা যত সহজ ভাবছেন, এটা মোটেই অতটা সহজ ছিল না। প্রতিমুহূর্তে নিজের সঙ্গে এক যুদ্ধ করতে হচ্ছে।

একসময় গভীর রাত ও নিস্তব্ধতা—দুটোই একসঙ্গে পাওয়া গেল। বিকাশ চেক করলাম। ব্যালেন্স দেখে একেবারে মাথা ঘুরে গেল! কতক্ষণ চোখ বন্ধ করে ছিলাম জানি না। কোনোভাবেই হিসাব মেলাতে পরছিলাম যে এটা কী করে সম্ভব? রশিদ সাহেবের চৌদ্দগুষ্টি আছে কি না জানি না। থাক বা না থাক, তাদের সবাইকেই উদ্ধার করলাম। নিজের সম্পর্কে মনে হলো সন্ধ্যার স্নিগ্ধ আলোয় যখন টিপ টিপ বৃষ্টির মধ্যে বাসায় ফিরছিলাম, তখন যদি ঠাটা পড়ে মৃত্যু হতো, সেটাও ভালো ছিল! রশিদ সাহেব দানশীল মানুষ। তিনি শুধু এই হতভাগাকে সালামি পাঠিয়ে ক্ষান্ত হননি; আরও অনেককে পাঠিয়েছেন। তাদের সঙ্গেও যোগাযোগ হলো। সবার প্রায় একই অভিজ্ঞতা। বলল, ভাই, লোকটাকে এত ভালো মানুষ মনে করতাম। কিন্তু সে আমাদের একেবারে ডুবিয়েছে!

লেখক: সাংবাদিক ও সংগঠক