আর পালাব না

প্রতীকী ছবি
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

নীতুর সঙ্গে প্রথম দেখা অঙ্ক স্যারের প্রাইভেটে। অঙ্ক পড়াতেন মিজান স্যার। চোখের ওপর গোল চশমাটা সব সময় থাকত। ভয়ংকর রাগী মানুষ। একটু ভুল হলেই পিঠের ওপর সপাং করে বেত মারতেন। তাঁর বেতের বাড়ি থেকে রক্ষা পেয়েছে, এমন কেউ আছে বলে এখন পর্যন্ত কারও জানা নেই। সেদিন নীতুর হাতেও পড়েছিল এক ঘা। দাঁত কামড়ে সহ্য করে নিয়েছিল। নীতু অভির এক ব্যাচ সিনিয়র। সাদামাটা, ছিপছিপে গড়নের কিছুটা রোগাটে চেহারার। নীতুকে প্রথমবার দেখার পর থেকেই একটা ভালো লাগা কাজ করতে থাকে অভির মনে। প্রায় সময়ই অঙ্ক করার ফাঁকে লুকিয়ে তাকিয়ে থাকত তার দিকে। ফলস্বরূপ, অঙ্কে ভুল। তারপর মিজান স্যারের বেত চড়াও হতো পিঠে।

একটা সময় দেখল নীতুও তার তাকিয়ে থাকার বিষয়টা খেয়াল করে। তবে কিছু বলে না। ধীরে ধীরে তার ভালো লাগাটা প্রখর হতে শুরু করে। নীতুকে প্রতিদিন দেখতেই হবে, এমন কিছু। রাতে বইয়ের সামনে বসে প্রায়ই হিসাব কষে, নীতু কি তাকে আদৌ পছন্দ করে, নাকি করে না? সে এভাবে তার দিকে তাকায় কেন? এসব প্রশ্ন নিয়ে বিরাট দ্বিধায় পড়ে। দ্বিধা দূর করতে কাগজের টুকরা ছিঁড়ে সেখানে একপাশে নীতু+অভি, অন্যপাশে নীতু+অন্য কেউ লিখে টস করত। নীতু যদি পছন্দ করে, তাহলে নীতু+অভি আসবে। যখন উল্টোটা ভাসত, তখন মন খারাপ হতো খুব।

মনের ভেতর ভালোবাসা পোষা এক মহা যন্ত্রণার বিষয়। কিন্তু প্রকাশ করাটা আরও বেশি ভয়ানক ব্যাপার। নীতুকে ভালোবাসি, কথাটা জানাতে পুরো একটা বছর লেগেছিল। ফাইনাল পরীক্ষার কয়েক দিন আগে। সেদিন স্যারের এখানে নীতু একটু আগেই এসেছিল। অভি এবার সিদ্ধান্ত নেয় যে যা হওয়ার হবে, আজ বলেই দেবে মনের কথা। তার সামনে মাথাটা কিছুটা নিচু করে ভয়ে-রোমাঞ্চে ঘামতে ঘামতে বলে, ‘নীতু, তোমাকে আমি পছন্দ করি। ভালো লাগে। তোমাকে ভালোবাসি।’ বলেই বই নিয়ে ভোঁ দৌড়। পেছন ফিরে তাকানোর আর সাহস হয়নি। সেদিনের পর আর প্রাইভেটেও আসেনি ভয়ে। তা ছাড়া বার্ষিক পরীক্ষাও শুরু হয়ে গিয়েছিল। নীতুর সঙ্গে আর দেখা নেই।

অনেক দিন পর।

অভিরা তখন ঢাকায় থাকে। সবে ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে। বন্ধুরা মিলে আড্ডা দিচ্ছিল ক্যাম্পাসে। হঠাৎ দেখে নীতু আসছে এদিকে।

তুমি এখানে?

হ্যাঁ। ভর্তি হয়েছি পরশু। এক বছর গ্যাপ ছিল।

বন্ধুদের আসছি বলে নীতুর সঙ্গে হাঁটতে শুরু করে সামনের দিকে।

তারপর তাদের জমানো কত কথা...।

ভার্সিটিতে ক্লাস শেষে যাওয়ার সময় নীতুকে এগিয়ে দিয়ে আসে তার বাসা পর্যন্ত। যেহেতু সে নতুন, তাই তার তেমন বন্ধুবান্ধবও জোটেনি আর তেমন চেনাজানাও নেই। সময় পেলেই দুজন মিলে রিকশায় ঘোরে, গল্প করে, কেনাকাটা করতে যায়। ধীরে ধীরে ভালো লাগার টানটা আবার বেড়ে ওঠে মনে। যদিও কেউ কাউকে কিছু জানায়নি।

একদিন অভি নীতুকে ফোন করে বলে, ‘নীতু, খুব মন খারাপ। টিএসসির এদিকে আসতে পারবে? চা খেতে যাব, তারপর দুজন মিলে হাঁটব।’ নীতু হ্যাঁ বলে।

নীতু ঠিক সময়ে চলে আসে। সত্যি বলতে সেদিন মন খারাপ বলে কিছুই ছিল না। নীতুকে দ্বিতীয়বার প্রপোজ করার জন্য ডেকে এনেছিল। কিন্তু কীভাবে তাকে কথাটা বলবে, তাই ভেবে উঠতে পারছিল না। অনেকটা অন্যমনস্ক লাগছিল তাকে। দুজন মিলে চা খেয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছিল কার্জনের দিকে। হঠাৎ সামনে কিছু ঘাস ফুল পড়ল, সেখান থেকে একটা ঘাস ফুল এনে তার হাতে দিয়ে বলল—

‘অর্থনৈতিক দুরবস্থার দিনে শূন্য পকেটে চলে যাবে যাপিত জীবন,

সেদিনও ভালোবেসে বুনো ঘাসেদের থেকে চেয়ে এনে দেব সতেজ নাকফুল,

ভালোবাসবে?’

নীতু ফুল হাতে নেয়। তারপর তাচ্ছিল্য করে বলে, লাভ কী ভালোবেসে, পরে তো দৌড়েই পালাবে!

এবার আর পালাব না। তোমার হাতটা ধরতে পারি।

সারা জীবন যদি ধরে রাখতে পারো, তবেই ধরো।

অভি চুপচাপ আরেকটু পাশ ঘেঁষে নীতুর হাতটা ধরে সামনের দিকে হাঁটতে থাকে।

ড্যাফোডিল স্থায়ী ক্যাম্পাস বন্ধুসভা