আমি সাহসী মানুষ ভালোবাসি

মুক্তির গান প্রামাণ্যচিত্রের একটি দৃশ্য
ছবি: সংগৃহীত

মানুষ জন্ম নিয়েই হাত-পা ছুড়ে চিত্কার করে জানায়, সে পৃথিবীতে এসেছে। পৃথিবীটাও তাকে বাঁচানোর অঙ্গীকার দিয়ে বলে, ‘লড়াই করে বাঁচতে হবে। লড়াই করে জিততে হয়। লড়াই ছাড়া বাঁচন নেই।’

সেই জন্মমুহূর্ত থেকে সে লড়াই করতে শেখে, পৃথিবীর দারুণ কঠিন বাস্তবতা তাকে লড়াইয়ের ব্যস্ততার জগতে নিয়ে যায়। বলতে শেখায়, ‘লড়াই লড়াই লড়াই চাই। লড়াই করে বাঁচতে চাই।’

আমি যদি একটু পেছনের দিকে তাকাই—আরও আরও আরও পেছনের দিকে তাকাই, ভাবতে পারি প্রস্তরযুগ, তাম্রযুগ, লৌহযুগ পেরিয়ে মানুষ সভ্যতার যুগে পা দিয়েছে। সেই সভ্যতার ইতিহাসকে যাঁরা আলোকিত করেছেন, তাঁরা কিন্তু যুদ্ধ, লড়াই-সংগ্রামের কোনো বিকল্প ধারা সামনে পাননি। ব্যস্ততা, পরিশ্রম আর যুদ্ধের নামতা পড়ে পড়ে বিজয়ের ধারাপাত তৈরি করেছেন তাঁরা।

আমি যদি আমার নিজের পেছনের দিকে একটু তাকাই—মনে পড়ে নানির কথা। তিনি বলেছিলেন, ‘জন্মমুহূর্তে আমাকে মায়ের দুধ খেতে দেওয়া হয়নি। কারণ, মা আমার অসুস্থ ছিলেন। ডাক্তারের নিষেধ ছিল। ভাতের ফ্যানের সঙ্গে গুড় গুলে আমাকে খেতে দেওয়া হতো।’ আহা, পরের জীবনে সেই গুড়-মিষ্টি আমার ততটুকুও পছন্দ ছিল না। তবে সেই যে যুদ্ধ দিয়ে জীবন গড়তে শুরু করেছিলাম বাঁচার তাগিদে, বেড়ে ওঠার তাগিদে, মানুষ হয়ে মানুষের সঙ্গে সখ্য গড়ার তাগিদে—আজও কম-বেশি প্রায় সবাই জীবনগাথার ভিন্ন ভিন্ন তাগিদে, ভিন্ন ভিন্ন চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে ভিন্ন ভিন্ন মাত্রার সংগ্রামের ইতিহাসের সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকেছেন।

দরিদ্র মা-বাবার ঘরে জন্ম নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার পথটা বড্ড প্রতিবন্ধকতায় ভরা ছিল আমার। অনেক অপেক্ষা করে করে শিক্ষাজীবন নিয়ে ষাটের দশকের উত্তাল দিনগুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বদরুন্নেসা কলেজ পেরিয়েছি আমি। বন্ধুরা, দারুণ উত্তেজনা, আন্দোলন, মিছিল-স্লোগানে ভরপুর ছিল সেই সব সময়। আমি ১৯৬৪, ১৯৬৫, ১৯৬৬, ১৯৬৭, ১৯৬৮, ১৯৬৯, ১৯৭০ এবং ১৯৭১ সালের দেশ, সমাজ, রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। যুক্ত ছিলাম স্বাধীনতাযুদ্ধের পটভূমিতে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের পর স্বাধীনতার ডাকের সঙ্গে। চলে গিয়েছিলাম স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রে শব্দসৈনিক হিসেবে। তারপর স্বাধীনতা—তারপর অন্য জীবন আমার। পিতৃহারা তিন বছরের সন্তান সুমি সিকানদারকে নিয়ে নতুন যুদ্ধ-জীবন।

কাজী রোজী
ছবি: সংগৃহীত

এ রকম যুদ্ধ-জীবন অনেকের আছে। তোমরা যারা তোমাদের পূর্বপুরুষের কথা জানো, তারা তোমাদের জানিয়েছেন তাঁদের চলার পথপরিক্রমার অনেক মজার মজার গল্প-সংগ্রাম-ইতিহাস। কীভাবে তাঁরা সব উত্তরণের পথকে অতিক্রম করেছেন, সেসব শুনলে শিহরিত হতে হয়। বিশ্বাস হতে চায় না। আসলে আগের দিনের সঙ্গে আজকের দিনের অনেক তফাত। এখন সময় পাল্টেছে, যুগ পাল্টেছে। পাল্টেছে সমাজ, সংস্কৃতি, চিকিত্সা, শিক্ষা ও সার্বিক পরিস্থিতি। বদলেছে আধুনিক প্রযুক্তিবিদ্যা। বিশ্বায়নের সঙ্গে মেলানো হয়েছে দেশ-কাল এবং মানুষের সার্বিক চাহিদা। জাগ্রত বুদ্ধিবৃত্তির বিভিন্ন কৌশল মানুষকে সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার পথ করে দিয়েছে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে থেকেছে লড়াই, যুদ্ধ-সংগ্রামের নিজস্ব ঘরানার গতিধারা। জানত, কালপুরুষের একটা প্রিয় গতি থাকে, বাঁক ফেরানো নদীর মতো চলন থাকে, যতটাই জীবন তাঁর, ততটাই ভালোবাসা নিয়ে, অনির্বাণ চাওয়ার কাছে কেবলই পাওয়ার আশা থাকে। আমারও অনেক চাওয়া-পাওয়ার অবস্থান ছিল। কিন্তু চাওয়ার সঙ্গে পাওয়ার ব্যবধানের দূরত্ব পথ আমাকে বারবার হোঁচট খাইয়েছে। ১৯৯৪ সালে কঠিন ও দুরারোগ্য ক্যানসার আমাকে আক্রমণ করেছিল। সে এক অন্য যুদ্ধ, অন্য সংগ্রাম। প্রতিনিয়ত সে যুদ্ধের সঙ্গে সক্রিয় থাকতে হয়েছে। কেমোথেরাপি নেওয়া, অপারেশন করা, ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে দিন-কাল-ক্ষণ কাটিয়ে নেওয়া সত্যিই এক অভিনব অভিজ্ঞতা। খাবার সামনে আছে কিন্তু খেতে না পারা, আসলে ইচ্ছে করে না, মানুষ সামনে আছে কিন্তু কথা বলতে ইচ্ছে করে না। এসব উপসর্গের সঙ্গে আরও অনেক কষ্ট, দুঃখ, জ্বালার উপসর্গ এ সময় যুক্ত হয় শরীরে, মনে। কিন্তু সবকিছু আমি জয় করেছি সাহস, মনোবল, ব্যস্ততা ও পরিশ্রম দিয়ে। বলেছি, ক্যানসারের অ্যানসার আমার কাছে আছে। ক্যানসার হলেই মৃত্যু হয় না।

ভালো-মন্দ বিচার নয়, চলার পথকে সামনে নিয়ে ডানে-বাঁয়ে না তাকিয়ে, কাজ আর কাজকে বন্ধু ভেবে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর তাগিদে আজও বেঁচে আছি আমি। তাগিদ শব্দটি লড়াকু মানুষের জীবনে বড্ড প্রয়োজন। তাদের কিছু বলে দিতে হয় না। দেশ, কাল, সমাজ, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে, অর্থনৈতিক অবস্থা, সাংস্কৃতিক জগত্ তাদের বলে দেয়, তাগিদ দেয়—কখন কী করতে হবে। এবারে অন্য একজনের কথা বলি—তারপর আবার ফিরে আসব নিজের কথায়।

বয়সে তিনি আমার চেয়ে বেশ বড়। কিন্তু প্রীতি-সংযোগের কোনো কমতি ছিল না তাঁর ভেতরে। বন্ধুর মতো পাশে বসে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ছাতার বেষ্টনীর নিচে কী যে নিবিড় আন্তরিকতার সঙ্গে সব জানালেন তিনি। মনে হলো, যেন কতকালের চেনা। না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।

নাম তাঁর ইলা মিত্র। ১৯২৫ সালে জন্ম। বাবা নগেন্দ্রনাথ সেন। মা মনোরমা সেন। স্বামী রমেন্দ্রনাথ মিত্রের অনুপ্রেরণায় ইলা মিত্র কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় সদস্য হন। নাচোলের আন্দোলন-ইতিহাস বলতে বলতে তিনি কীভাবে ‘রানি মা’ হতে পেরেছিলেন, তা-ও জানালেন লড়াকু নারী ইলা মিত্র।

ইলা মিত্র
ছবি: সংগৃহীত

আরও যে কত কথা বলেছিলেন, সব কথা আজ গুছিয়ে জানাতে পারব না। তবে কীভাবে দক্ষ কর্মী হতে হয়, কীভাবে তেভাগা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে হয়, কীভাবে কারা-নির্যাতন ভোগ করেও প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সঙ্গে ছায়া-সংযোগ রাখতে হয়—এসব গল্প শুনতে শুনতে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের রোদের ভালোবাসা সন্ধ্যার প্রদীপ জ্বালিয়ে দিয়েছিল, এখনো মনে পড়লে নিজেকে অত্যন্ত সমৃদ্ধ ও মূল্যায়িত মনে হয়। এসব কথা তোমাদের বলছি জীবনঘনিষ্ঠ এসব উচ্চারণ চলার পথে দিকনির্দেশনা দেয়। তরুণ সমাজকে প্রাণবন্ত ও উচ্ছল জীবনের গান শেখায়। নিজস্ব ভঙ্গিমায় যাপিত জীবনের ধারাপাত নয়, যুগে যুগে, কালে কালে এ ধরনের অসংখ্য সাহসী যোদ্ধাই তো দেশকে নবজাগরণের পথের পথিকৃত্ তৈরি করেছেন।

একজন নারী তাঁর সন্তানকে শাশুড়ির কাছে রেখে দেশের ডাকে সাড়া দিয়ে কীভাবে সংগ্রাম করেছেন—ইলা মিত্র তারই উজ্জ্বল এক দৃষ্টান্ত। তিনি অগ্রপথিক আমাদের যাত্রাপথে।

আবার বলছি,

নিজের কথা তোমাদের সঙ্গে বিনিময় করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সব কথাই যুদ্ধবিগ্রহ, কষ্ট-বেদনাকে আচ্ছন্ন করে আছে। সাফল্য কিংবা অর্জনের ঝুড়িতে রেখেছি আমার কবিতার শব্দমালা। আগেই বলেছিলাম, ভেতরের তাগিদ বা তাড়না মানুষকে নতুনভাবে পথ চলতে শেখায়। আমিও সম্পূর্ণ বিবেকের তাড়নায় এই দেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য সাক্ষীর কাঠগড়ায় নিজেকে শামিল করেছিলাম। আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের ভরা এজলাসে দাঁড়িয়ে বলেছিলাম, ‘কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে আমি এখানে কাঁদতে আসিনি। ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি।’ কবি মেহেরুন নেসা এবং তাঁর পরিবারের মতো অসংখ্য শহীদের পক্ষে আমার জেরা ও সাক্ষ্য এবং অসংখ্য সাক্ষী অবশেষে ফাঁসির আদেশ কার্যকরের অবস্থা তৈরি করেছেন। আমি জানি, সব শহীদের আত্মা তৃপ্তি পেয়েছে।

আমি সাহসী মানুষ ভালোবাসি। যোদ্ধা মানুষ ভালোবাসি। আজ তাই তোমাদের সঙ্গে ইলা মিত্রের সাহস ও সংগ্রামের কথা উচ্চারণ করলাম। তোমরা তাঁর কথা আরও জানবে এবং বুঝবে, যুদ্ধ-সংগ্রাম জীবন-সংগ্রামের বন্ধু।