আমার রেজা মামা

প্রয়াত আহমেদ রেজাউল করিম
ছবি: সংগৃহীত

মনে পড়ে ছোটবেলায় ‘মা একটা ছড়া বলো তো’ বলে আমার কত্ত ভিডিও করত রেজা মামা। এমনকি বড় হওয়ার পরেও ‘এইযে এখানে দাঁড়া, ছবি ভালো আসবে’ বলে কত্ত ছবি তুলে দিত। ভাবতেই অবাক লাগে, সেই রেজা মামা আজ আর নেই।

রেজা মামা ও তাঁর পরিবার
ছবি: সংগৃহীত

ভীষণ মজার মানুষ ছিল রেজা মামা। সবাইকে নিয়ে ঘুরতে যাওয়া, আনন্দ-ফুর্তি করা তার ভালো লাগত। ভাগনিদের জন্য আলাদা এক ধরনের স্নেহ ছিল। যেকোনো পরীক্ষার আগের দিন রেজা মামা এসে উপস্থিত। মামার সামনে মাও কখনো আমাদের বকা দেওয়ার সাহস পেত না। আমরা বোনরা কখনো সাজগোজ করলে আদর করে আমাদের ‘মডেল’ ডাকত। আমাকে মজা করে বলত, ‘তোকে তো আমি মডেল বানাব। অ‍্যাক্টিং করবি?’ সবাইকে নিয়ে সেলফি তুলবে বলে সেলফি স্টিক কিনেছিল মামা। সুন্দর সুন্দর ডায়রি, কলম, নোটবুক পেলেই আমাদের জন্য নিয়ে আসত। অভিভাবক হিসেবে আমাদের পরিবারের সবাইকে একসাথে আগলে রাখার কাজটিও রেজা মামা সঠিকভাবে করে যেত। একদিকে সবাইকে আপন করে নেওয়া, অন্যদিকে সবার সাথে সমানভাবে যোগাযোগ বজায় রাখা—সব চলত সমানভাবে। এই করোনা পরিস্থিতিতে কারও সাথে যেন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন না হয় এবং সবাই যেন দূরে থেকেও কাছে আসতে পারে, তাই মামা মেসেঞ্জারে গ্রুপ খুলেছিল। রেজা মামা নিয়মিত সেখানে ভিডিও কল দিতেও ভুলত না। গত বছর রমজানে প্রতিদিন ইফতারের পর কল দিয়ে সবাইকে দেখতে চাইত। আমাদের কোনো ভালো রেজাল্ট, ভালো খবর শুনলে যা খুশি হতো, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

রেজা মামার সঙ্গে তাঁর ভাগ্নিরা
ছবি: সংগৃহীত

গত বছর ঈদুল ফিতরের পর, অর্থাৎ মে মাসের শেষের দিকে রেজা মামা ভিডিও কলে এলে আমাদের বলত তার শরীর খারাপ লাগছে। আমরা সবাই চিন্তিত হয়ে যাব বলে মামা আমাদের সান্ত্বনা দিয়ে বলত, ‘আরে, কিছু হয় নাই আমার। ঠিক হয়ে যাচ্ছি।’ কিন্তু দিনে দিনে যে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হচ্ছিল, তা আমরা কেউ বুঝিনি। মামা নীরবেই পুরো সময় লড়ে গেল কিন্তু কাউকে বুঝতে দিল না। অবশেষে ৫ জুন মামার শরীর অতিরিক্ত খারাপ হয়ে গেলে তাকে বেলা ১১টায় হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে নেওয়া হলে করোনা টেস্ট করা হয় এবং জানা যায় মামার করোনা পজিটিভ। মামার অক্সিজেন স‍্যাচুরেশন (Saturation) অনেক কম ছিল এবং তার শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল। অক্সিজেন সিলিন্ডারের ব্যবস্থা করা হয় এবং অন‍্যান‍্য যাবতীয় আয়োজনও করা হয়। কিন্তু শত চেষ্টার পরও তাকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। সেদিন রাত সাড়ে ১১টায় রেজা মামা শেষনিশ্বাস ত‍্যাগ করে।

মা ও ভাই-বোনদের সঙ্গে রেজা মামা
ছবি: সংগৃহীত

এই করোনা নামের অভিশাপে অনেকে তাদের আপনজন হারিয়েছে। কাছের কোনো মানুষকে হারানোর কষ্ট যে হারায়, সে ছাড়া আর কেউ বুঝতে পারে না। আমি আমার অভিভাবক, আমার বড় মামা কে হারিয়েছি। কেউ আর এখন আদর করে ‘মডেল’ ডাকবে না। কাছে পেলে মাথা টিপে দিতে বলবে না। রেজা মামার সাথে আর কোনো দিন ছবি তুলতে পারব না, তার প্রাণবন্ত হাসিটা আর দেখতে পারব না। এখন কেবল ছবি আর স্মৃতিতেই রয়ে গেল মামা। কত ভালো হতো যদি শেষবারের মতো মামাকে জড়িয়ে ধরে জানাতে পারতাম সবাই তাকে কত্ত মিস করে।

লেখক: প্রথম আলো বন্ধুসভা জাতীয় পর্ষদের সাবেক সহসভাপতি প্রয়াত আহমেদ রেজাউল করিমের ভাগ্নি