আমার বন্ধুসভা

আব্দুন নূর তুষার
ফাইল ছবি

আমি চার বছর প্রথম আলো বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি ছিলাম। প্রথম আলোয় চাকরি করেন না বা সরাসরি সম্পৃক্ত নন, এমন সভাপতি এখন পর্যন্ত আমি একাই। তবে প্রথম আলো ও বন্ধুসভার সঙ্গে আমার পথচলা শুরু থেকেই।

বন্ধুসভা প্রথম আলোর পাঠকদের সংগঠন। তবে এটাতে মূলত তরুণেরা অংশ নিয়ে থাকেন। বন্ধুসভার কাজ হলো, যা কিছু ভালো ও প্রয়োজনীয় সেটা করা। বন্ধুরা নিজেদের উন্নয়নের জন্য যেমন কাজ করেন, তেমনি সমাজের নানা প্রয়োজনে এগিয়ে আসেন। বন্ধুসভায় আমার দেওয়া সময়টুকুকে আমি আনন্দময় হিসেবে স্মরণ করি। বন্ধুসভার নিয়মিত বৈঠক আয়োজন, আলাদা কক্ষ বরাদ্দ, সংবিধান পুনঃপ্রণয়ন, ছোট একটি পাঠাগার তৈরি, প্রথম আলোর তহবিল থেকে নিয়মিত বার্ষিক বরাদ্দপ্রাপ্তির বিষয় আমার সময়েই হয়।

রওশন ভাই সব সময় ছিলেন সবকিছুতে। আর ছিলেন আনিসুল হক। তিনি লেখক, কিন্তু তাঁর নেতৃত্বগুণ অসামান্য। প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানের কাছে আবদার করে অনেক কিছুই নিয়ে এসেছি, কিন্তু আরও আগে থেকেই সবচেয়ে বড় যে কাজটি বন্ধুসভা শুরু করেছিল, সেটি হলো বন্ধু সমাবেশ।

সবাই একত্র হয়ে নিজেদের বন্ধুত্বকে আরও শক্তপোক্ত করার এই জমায়েত, বন্ধুদের দূর–দূরান্ত থেকে কাছে আনে। এখানেই আমি বহু তরুণের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি, যাঁরা আমার জীবনে স্থায়ী হয়ে গেছেন।

বন্ধুসভার সঙ্গে গিয়েছি সেই টেকনাফ, পঞ্চগড়, বগুড়া, জয়পুরহাট, বাগেরহাটে। কখনো স্কুলের পড়ার বেঞ্চ, কখনো তাঁতিদের সুতা, কখনো বন্যাদুর্গত ব্যক্তিদের খাবার, আবার কখনো শীতার্ত ব্যক্তিদের জন্য কম্বল নিয়ে। বন্ধুসভার সদস্যদের কোনো ক্লান্তি নেই। বিতর্ক প্রতিযোগিতা আয়োজন শুরু করল বন্ধুসভা, এমনকি ক্যারিয়ার গাইডেন্স, সাংস্কৃতিক উৎসবও।

বন্ধুসভা আগামী দিনের নেতাদের গড়ে তোলে। এ সংগঠন সচেতন তরুণদের আগামী দিনের যোগ্য নাগরিক হিসেবে তৈরি করে। এখানে যাঁরা আসেন, তাঁরা উদার, কর্মঠ, গুণী ও মেধাবী। তাঁদের কেউ পড়াশোনায় ভালো, কেউ গান করেন ভালো, কারও নাচে উৎসাহ, কেউ আবৃত্তি করেন, কেউ খেলেন। এমনকি সুন্দরী প্রতিযোগিতার সেরারাও এখানে কাজ করেছেন। কারণ, এখানে সবাই সমান।

বন্ধুসভা তাই এক অনন্য সংগঠন। এখানে কেউ থাকার জন্য আসেন না, শিখতে আসেন। তারপর পৃথিবীর পথে পদচিহ্ন এঁকে দিতে চলে যান। মুসা ইব্রাহিমও বন্ধুসভায় কাজ করেছেন, নিশাত মজুমদারও বন্ধুসভা করেছেন। ভাবতে ভালোই লাগে, এভারেস্টের ওপরেও পড়েছে বন্ধুসভার সদস্যদের পায়ের ছাপ।

বন্ধুসভার সদস্যরা হাসিমুখে কঠিন কাজগুলো যখন অবলীলায় সম্পন্ন করেন, তখন মনে হয় বাংলাদেশের মানুষের অসাধ্য কোনো কাজ নেই। মানুষ বন্ধুসভাকে আপন ভাবে। তরুণের সাহস ও প্রবীণের অভিজ্ঞতা এক জায়গায় এনে বন্ধুসভা অসম্ভবকে সম্ভব করে। সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা সদস্যরা একমুহূর্তে এক হয়ে যান। ডেঙ্গু জ্বর প্রতিরোধ, মশকনিধন অভিযান, পরিচ্ছন্নতা কর্মসূচি, মাদকের বিরুদ্ধে ‘না’—কোনো কাজে বন্ধুসভা পিছপা হয় না। নন্দলালের মতো শুয়ে থাকা নয়, পাছে লোকে কিছু বলে এ দ্বিধায় জড়সড় হয়ে নয়, বরং দুর্বার, স্বাধীন, চঞ্চল, উদ্দাম বন্ধুসভার সদস্যরা এগিয়ে যান যৌবনের দৃপ্ত অহংকারে।

আমি আমার জীবনের সুন্দর একটা সময় কাটিয়েছি বন্ধুসভার সঙ্গে। আমার প্রতি সদস্যদের সম্মান, ভালোবাসা ও সহযোগিতা এতই নির্ভেজাল ছিল যে আমাকে কোনো কথা বলতে হয়নি। কোনো কাজের নির্দেশ দিতে হয়নি। যেন স্বয়ংক্রিয়ভাবেই সব হয়ে গেছে। আর এর পেছনে ‘রওশন’ নামক উজ্জ্বল মানুষটির বিরাট অবদান ছিল। আরও ছিলেন মোহিত কামাল ভাই, জাহীদ রেজা নূর।

বন্ধুসভায় আমার যাওয়া–আসা বন্ধ হয়নি। এটা সম্ভব না। বয়স বাড়ছে, কিন্তু বন্ধুসভায় এলে আমি ৩০ বছরের যুবক হয়ে যাই। এত প্রাণের মধ্যে নিষ্প্রাণ হয়ে বসে থাকা সম্ভব নয়। এত প্রবল ভালোবাসার স্রোতে ডুবে যাওয়াই মনে হয় শ্রেয়। ভালো কাজে যুক্ত হওয়ার এর চেয়ে ভালো সুযোগ আর কোথায়?

তাই যখন বন্ধুসভা ডাক দেয়, ঘরে বসে থাকা যায় না। আমি দেখতে পাই, লাখো তরুণ তাঁদের উজ্জ্বল চোখ দিয়ে ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখছেন, আর তাঁদের সবল হাত দিয়ে সেই ভবিষ্যৎকে গড়ছেন। আমি দেখতে পাই আগামী দিনের সবল, সক্ষম ও সপ্রতিভ নারীদের, যাঁরা বদলে দেবেন এই দেশ। দেখতে পাই সেসব পুরুষকে, যাঁরা বড় হয়ে উঠলে পুরুষতন্ত্র শব্দটি অভিধান থেকে মুছে যাবে।

আমি কেবল বন্ধুদের পৃথিবী দেখি। যেখানে ঈর্ষা নেই, ঘৃণা নেই, বিদ্বেষ নেই, হানাহানি নেই, মিথ্যা নেই, দুর্নীতি নেই, যুদ্ধ নেই। দেখি বন্ধুরা মিলে গড়ে তুলবেন এমন পৃথিবী, যেখানে আছে স্বাধীনতা, আছে অধিকার, আছে সাম্য, আছে সুন্দর, আছে বন্ধুত্ব আর আছে ভালোবাসা।

আব্দুন নূর তুষার: গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব ও চিকিৎসক। সভাপতি, প্রথম আলো বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদ (২০১০–১৪)

(লেখাটি প্রথম আলো বন্ধুসভার ‘পঞ্চম জাতীয় বন্ধু সমাবেশ ২০২০’–এর স্মরণিকা থেকে নেওয়া হয়েছে)