আমার জীবনে আলোর প্রদীপ তুমি ‘মা’

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

বলার মতো কোনো অর্জন নেই জীবনে, কিছুই এখনো অর্জন করতে পারিনি আমি। যা পেতে চেয়েছি, নিতে চেয়েছি, প্রচেষ্টার ত্রুটি কিংবা নিয়তির নিষ্ঠুরতায় তার কিছুই হয়নি আমার। আত্মীয়স্বজন, পরিচিত অনেকের কাছে আমি তাই অতটা মূল্যবানও নই। যতটা মূল্য একজন আরেকজনের কাছ থেকে প্রত্যাশা করে, একজন মানুষের আরেকজন মানুষকে দেওয়া কর্তব্য। তারপরও কেউ না থাকা এ জীবনে একটি আলোর প্রদীপ আছে আমার। নিত্যদিন যার পরশে আমার সব দুঃখ মুছে যায়। আমি নতুন উদ্যমে এগিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ শুরু করি।

উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার কিছুদিন আগের কথা। ফরম পূরণের প্রয়োজনীয় কাজ শেষে পরীক্ষার প্রস্তুতি গুছিয়ে নিতে ব্যস্ত আমি। বাইরে যাতায়াত কমেছে। দুচোখে নতুন স্বপ্ন, ভালো ফল করতে হবে আমাকে। কিন্তু নিয়তির নিষ্ঠুরতা পিছু ছাড়ে না আমার। ফরম পূরণ সম্পন্ন হওয়া পরীক্ষার্থীদের জন্য প্রিন্ট করা তথ্য যাচাইকরণ শিট মারফত জানতে পারলাম, আমার ফরম পূরণ হয়নি। প্রয়োজনীয় টাকা আর কাগজ জমা দিলেও টাকা জমা দেওয়ার ‘রশিদ বই’ জমা না দিয়ে আসার ফলে কম্পিউটার অপারেটর আমার ডেটা এন্ট্রি করতে পারেননি বলে জানাল কলেজ কর্তৃপক্ষ। বাবা কলেজে গেলেন, অধ্যক্ষ আশ্বস্ত করলেন একটা ব্যবস্থা হবে। তবুও চোখের জল বাধা মানে না আমার। একেকজন একেক রকম কথা বলছেন। বাড়ির অনেকে আমাকে গালাগাল করছেন, সঙ্গে মাকেও। মায়ের জন্য আমি এমন হয়েছি, কোনো কিছুতে গুরুত্ব দিই না, লাই দিয়ে দিয়ে মা আমাকে মাথায় তুলেছে, এ বছর পরীক্ষা দিতে না পারলে আমার আর পড়ালেখার প্রয়োজন নেই ইত্যাদি।

সব হারানো পথিকের মতো সারা দিন চুপচাপ বসে থাকি আমি। কারও কথার উত্তর দিই না। চুপচাপ শুনি আর কান্না করি। মা কাজের ফাঁকে ফাঁকে মাথায় হাত বুলিয়ে যায়। আর বলেন, ‘বলেছি না তোর ফরম পূরণ হবে। তুই পরীক্ষা দিবি। চুপচাপ বসে না থেকে পড় গিয়ে।’ অন্যদিকে কথার ছুরি নিয়ে আসেন কেউ কেউ। বেদনার ভারে পর্যুদস্ত মনটাকে ফালাফালা করে দিয়ে যান। তবুও আশা ছাড়েন না মা। এককথা তার—আমি পরীক্ষায় বসতে পারব। তারপরও একটি অনিশ্চয়তা রয়ে যায়। বিশ্বাস করতে সাহস হয় না আমার। তবে দুই-তিন দিন যেতেই সমস্ত অনিশ্চয়তা কেটে যায়। মায়ের দৃঢ় বিশ্বাস ও কলেজ কর্তৃপক্ষের প্রচেষ্টায় ডেটা এন্ট্রি হয় আমার। সফলভাবে ফরম পূরণ শেষে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় বসার সুযোগ পাই আমি।

উল্লিখিত ঘটনার মতো জীবনের সমস্ত বিপর্যস্ততায় আমার একমাত্র ভরসা কেবল মা। আমার জন্য অনেক অনেক কথা শুনতে হয় তাকে। তবুও পাশ ছাড়ে না মা, আমাকে নিয়েই তার সব আয়োজন।
আমার পড়ালেখা জানা মা অত্যন্ত সাধারণ, সহজ-সরল। কোনো জটিলতা নেই তার মধ্যে। কী অসাধারণভাবে মা ভালোবাসতে পারে, আগলে রাখে পরিবারকে। নিজে না খেয়েও আমার খাওয়া দেখে তৃপ্ত হয় সে। আমার অসুস্থতায় তার পৃথিবী থমকে দাঁড়ায়। সামান্য জ্বরেও কী ভীষণ চিন্তিত হতে দেখি! এই টোটকা, ওই ওষুধ নিয়ে ছুটতে শুরু করে মা। আশ্চর্য চোখে তাকিয়ে আমি দেখি, বলার কথাটা মুখ ফুটে বলতে পারি না।

মায়ের সঙ্গে আমার ও বোনের টক–মিষ্টি সম্পর্ক। কথা-কাটাকাটি, মান-অভিমান ও হাসি–গানে আমাদের সময় কাটে। মায়ের অভিমান মেটাতে খুব বেশি বেগ পোহাতে হয় না আমাদের। কিছু সময় মুখ গোমড়া করে থাকলে কিংবা জড়িয়ে ধরলেই সব অভিমান জল হয়ে যায় মায়ের। পক্ষান্তরে আমার ও বোনের রাগ ভাঙাতে নাজেহাল হতে হয় মাকে।
এত কিছুর পরও জীবনের আলোর প্রদীপ, সহজ-সরল মমতাময়ী মাকেই কখনো বলা হয়ে ওঠে না, তোমার জন্যই এ পৃথিবীতে বেঁচে থাকা আমার। তোমার মতো করে আমাকে কেউ বোঝে না, ভালোবাসে না। আমার সমস্ত রাগে, অভিমানে, ভালোবাসায় কেবল তুমি মা।
প্রকৃতির জটিল নিয়মেই হয়তো জীবনে আষ্টেপৃষ্ঠে থাকা অসীম ভালোবাসার মানুষগুলোকে আমরা ভালোবাসার কথা বলে উঠতে পারি না। সযতন কেবল ভালোবেসে যাই। তারপরও ভীষণ মনখারাপের দিনে বুকের ভেতরটা কেমন যেন করে ওঠে আমার! চিৎকার করে খুব বলতে ইচ্ছা করে, ভীষণ ভালোবাসি মা। তুমি আর বাবা ছাড়া আমাকে কাছে টানার, ভালোবাসার আর কে আছে বলো! কেউ নেই। আমরা যাদের শুভাকাঙ্ক্ষী ভাবি, আচরণে মনে করি—ভালোবাসে, দুঃখের দিনে পাশে থাকবে, ভীষণ প্রয়োজনের দিনে আদতে তারা কেউই পাশে থাকবে না। দারুণ অজুহাতে মুখ ফিরিয়ে নেবে। এ দর্শন তুমিই আমাকে দিয়েছ মা। বলেছ, আমি যেন ওদের মতো না হই। প্রত্যাশা ছাড়াই ভালোবাসতে শিখি, মানুষের পাশে দাঁড়াই। বাবার মতো হওয়ার চেষ্টা করি গুণে, আন্তরিকতায়, কর্তব্যপরায়ণতায়।
তুমি দেখো মা, তোমার ও বাবার ছায়ায় যান্ত্রিক জীবনের সব পথ আমি পাড়ি দিতে পারব। অবশ্যই ভালো মানুষ হব, বড় হব; মানুষকে ভালোবাসতে পারব।