আমার কাছে স্বাধীনতা মানে
‘শুধু ভিক্ষা করে কখনো স্বাধীনতা লাভ করা যায় না। স্বাধীনতা অর্জন করতে হয় শক্তি দিয়ে, সংগ্রাম করে। স্বাধীনতার মূল্য দিতে হয় রক্ত দিয়ে।’ (নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু)
আমার কাছে স্বাধীনতা মানে একটি দেশের সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি, যা ওই দেশটির জনগণের দুর্দমনীয় সংকল্পের গভীরে প্রোথিত শিকড়ে রস সঞ্চার করে ঐক্য চেতনার অমিয় ধারাকে বহন করে দেশকে তার কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যের দিকে নিয়ে যায়। একটি দেশ গঠনের জন্য প্রথমে প্রয়োজন ওই দেশের স্বাধীনতা। স্বাধীনতা ব্যতীত কোনো দেশ পরিপূর্ণ হতে পারে না। কিন্তু এই স্বাধীনতা কুড়িয়ে পাওয়া এক মুঠো মু্ক্তো বা বদান্যতার উপহার নয়। এই স্বাধীনতা অর্জিত হয় একটি জাতির কঠোর সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের বিনিময়ে।
রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে সোনার বাংলা, জীবনানন্দ দাশের দৃষ্টিতে রূপসী বাংলা, আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের স্বাধীনতাও কিন্তু খুব সহজে অর্জিত হয়নি। স্বাধীনতা অর্জনের পথে বাংলার মৃত্যুভয়হীন সূর্যসন্তানেরা আপন বুকের রক্তে পিচঢালা কালো রাস্তা রঞ্জিত করতেও দ্বিধাবোধ করেনি। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে মুক্ত হলেও আমাদের বাংলাদেশের জনগণ তখনো প্রকৃত স্বাধীনতা লাভ করতে পারেনি। শুরু হয় পশ্চিম পাকিস্তানিদের ঔপনিবেশিক স্বৈরশাসন, যেখানে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ হলো শোষিত এবং পশ্চিম পাকিস্তানিরা হলো শাসক। তাদের প্রথম আঘাত এসে পড়ে আমাদের প্রিয় মাতৃভাষা বাংলার ওপর। কিন্তু আমরা এই অবিচার মেনে নিইনি। চারদিক থেকে শুরু হয় ভাষা আন্দোলন।
অবশেষে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্র-জনতা রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। পাকিস্তান সরকার এই আন্দোলনকে স্তিমিত করার জন্য ছাত্র–জনতার ওপর গুলি চালায়। ফলে রফিক, শফিক, সালাম, বরকতসহ আরও অনেকে শহীদ হন। অতঃপর ১৯৫৬ সালের সংবিধানে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে পাকিস্তান সরকার বাধ্য হয়। অর্জিত হয় স্বাধীনতার জন্য বাঙালি জাতির প্রথম প্রয়াসে সাফল্য। এরপর পশ্চিম পাকিস্তানিদের নানা অবিচারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন আন্দোলন সংঘটিত হয়। ৬২–র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬–র ছয় দফা, ১৯৬৮-৬৯ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্য বন্দীদের আগরতলা মামলা থেকে মুক্তির জন্য আন্দোলন সংঘটিত হয়। বাঙালি জাতির ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায় যখন ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ সত্ত্বেও পশ্চিম পাকিস্তানিরা আমাদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে চায়নি। পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে সাংস্কৃতিক ভিন্নতা শুরু থেকেই ছিল, এসব ঘটনাপ্রবাহ রাজনৈতিকভাবেও দূরত্ব তৈরি করে পাকিস্তানের দুই অংশের নাগরিকদের মধ্যে।
অবশেষে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ উপস্থিত হয়—৭ মার্চ, ১৯৭১, যখন ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার ডাক দেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ তাঁর ডাকে বাঙালি জাতি স্বাধীনতা অর্জনের যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পাকিস্তানিদের অবস্থান দুর্বল হয়ে আসে। ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। আর কোনো উপায় খুঁজে না পেয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরে ঢাকার রমনা রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করে। অবশেষে অর্জিত হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা। বাংলাদেশের এই অর্জিত স্বাধীনতা সমগ্র দেশবাসীর বহুকাল লালিত মুক্তি ও সংগ্রামের অঙ্গীকারে ভাস্বর।
স্বাধীন বাংলার প্রারম্ভিককালে কিছু খয়ের খাঁ থমকে দিতে চেয়েছিল বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে। কিন্তু তারা হয়তো ভুলে গিয়েছিল, ঋতুচক্রের আবর্তনে শীতের সকাল যেমন কুয়াশাচ্ছন্ন হয়, ঠিক তার পরক্ষণে সূর্যের রৌদ্রোজ্জ্বল কিরণে সেই কুয়াশা কেটে যায়। তদ্রূপ, বাংলার যত সংকটই আসুক না কেন, কালের আবর্তে সেই সংকটকে চিরকাল আমরা করে এসেছি জয়, করছি জয় এবং করবও জয়। প্রায় ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে প্রাপ্ত এই স্বাধীনতা আমাদের অনুপ্রেরণা জোগায় দেশের উন্নয়নের নিমিত্তে কাজ করার জন্য।
আমার কাছে স্বাধীনতা মানে বাঙালি জাতির আত্মপরিচয়ের গৌরবে উজ্জ্বল এবং ত্যাগ ও বেদনায় মহীয়ান এক উদ্ভাসিত চেতনা। আজ আমাদের দায়িত্ব এক সমুদ্র রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশকে সুখী ও সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে বিশ্বের বুকে প্রতিষ্ঠা করা। স্বাধীনতা আমাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করে সবার জন্য মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার মহান আদর্শে উদ্বুদ্ধ করে। এই আদর্শগুলোর প্রকৃত রূপায়ণই আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের মূল লক্ষ্য। স্বাধীনতার ৫০তম বর্ষে পদার্পণকারী বাংলা মাতাকে দেখে সুকান্ত ভট্টাচার্যের একটি কবিতাই আজ ধ্বনিত হয় :
‘সাবাস, বাংলাদেশ, এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়;
জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার, তবুও মাথা নোয়াবার নয়।’
শিক্ষার্থী, এস, এম মডেল স্কুল, গোপালগঞ্জ