আমরা কেন একজন শাকির হয়ে উঠতে পারি না

দুই হাতে ঝুলিয়ে ত্রাণসামগ্রী নিয়ে যাচ্ছেন শাহ সিকান্দর আহমদছবি: সংগৃহীত

শাহ সিকান্দার শাকির। পরিচয় সিলেট বন্ধুসভায় কাজ করার সুবাদে। খাতা–কলমে হিসাব কষলে বছর পাঁচেক হবে হয়তো আমাদের পরিচয়ের। এ সময়ে মানুষটার আপাদমস্তক চেনা হয়েছে আমার। বড্ড কাজপাগল মানুষটা নিজের সবটা উজাড় করে দিতে সদাপ্রস্তুত। শহরের যখনই কোনো দুর্যোগ নেমে আসে, অসহায় মানুষের দ্বারে শাকিরের পৌঁছাতে এতটুকু বিলম্ব হয় না। অসহায় কিছু প্রাণ যেন শাকিরের আশায় বসে থাকে। কখন আসবে আমাদের শাকির? গত কয়েক বছরের এই শাকির যে বড্ড চেনা তাদের। খুব কাছের কেউ হয়ে উঠছে শহুরে এই শাকির।

আমরা সব কাজে সব সময় উদাহরণ খুঁজি। আরও সহজ করে বললে, সফল মানুষ খুঁজি। কেন খুঁজি বলতে পারেন? একটু ভরসা পেতে, একটুখানি সাহসের পাল্লা ভারী করতে। কিছু ক্ষেত্রে আমরা কাঙ্ক্ষিত উদাহরণ খুঁজে পাই, কিছু ক্ষেত্রে আবার পুরোপুরি ব্যর্থ হই। ব্যর্থ হই কেন জানেন? কারণ, আমরা আমাদের আশপাশের উদাহরণগুলো কখনোই তোয়াক্কা করিনি। করতে চাইওনি; বরং আমরা তাদের এড়িয়ে গিয়েছি সব সময়। যেন সেই এড়িয়ে চলায় আমাদের সব সুখ, আমাদের জীবনের সফলতা। বড্ড বোকা আমরা! তাই না?

বন্যার্তদের জন্য খাদ্যসামগ্রী নিয়ে যাচ্ছেন সিলেট বন্ধুসভার বন্ধুরা।
ছবি: সংগৃহীত

আমি বরং আমারই একটা উদাহরণ দিই। একজন সংগঠক হিসেবে সিলেট বন্ধুসভাই আমার কাছে প্রথম কোনো প্ল্যাটফর্ম। এই প্ল্যাটফর্মে পা না রাখলে বুঝতামই না, মানুষ হয়ে কেন বিপদে আরেক মানুষের পাশে এসে দাঁড়ানো উচিত। নতুন প্ল্যাটফর্ম, নতুন আমি। সবার অগোচরে খুঁজে বেড়িয়েছি এমন কাউকে, যাঁকে দেখলে মনে হবে, আমি ওনার মতো হব। কত খোঁজাখুঁজি করেছি। একেকবার একেক মানুষের সাংগঠনিক সফলতা দেখে মনে হয়েছে, আমি আসলে ওনার মতো হতে চাই। সেগুলো আসলে ভ্রম ছিল। পুরোপুরি না হলেও অনেকটাই ভ্রম। আজ আমি যখন নোটপ্যাডে এ লেখা লিখছি, তখন সচেতনভাবেই সগৌরবে সর্বসমক্ষে বলে দিতে চাই, আমি সব সময় একজন শাকির হতে চেয়েছি।

সেই শাকির, যে শাকিরকে দমানো যায় না, যে শাকিরের মনোবলকে শতচেষ্টায়ও ভেঙে ফেলা অসম্ভব, যে শাকির কটুবাক্যে এতটুকুও বিচলিত হন না, যে শাকির দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেন, যে শাকির কিছু অসহায় পরিবারে বড় ছেলের ভূমিকায় থেকেছেন সব ঝড়ঝঞ্ঝায়, যে শাকিরের সাংগঠনিক দক্ষতায় মুগ্ধ না হয়ে থাকা প্রায় অসম্ভব। আমি এমন শাকির হতে চেয়েছি। আমি এখনো আনমনে এমন শাকির হতে চাই। তবু যেন কিছু পিছুটান আমায় শাকিরকে ছুঁতে বারণ করে। কিন্তু কেন করে? আমার কি তবে সব কারণকে উপেক্ষা করে শাকিরের কাঁধে কাঁধ রেখে কিছু ভালো কাজের নেশায় মত্ত রাখা উচিত নিজেকে? আমি কি তা–ই করব?

সবাই সবাইকে ভালোবাসবে না, আপন করে নেবেও না। চাইলেও হয়তো সম্ভব নয়। শাকিরের বেলায়ও একই দর্শন। শাকিরকে আপনার ভালো লাগতেও হবে না। আপনার ভালো লাগা, মন্দ লাগায় শাকিরদের কিছু আসে–যায় না। শাকিরদের মন অনেক বড় হয়। বড় হয় বলেই সবার এত এত অসহযোগিতা আর অশোভন আচরণের পরও শাকিররা তাঁদের ভালো কাজ চলমান রাখেন। এখানেই হয়তো আমাদের সঙ্গে শাকিরদের মূল পার্থক্য।

আমি চাই আপনারা শাকিরের কাজকে ভালোবাসুন, শাকিরকে নয়। শাকিরের ভালো কাজের সঙ্গী হোন। শাকিরকে সহযোগিতা করুন। শাকিরকে সাহস জোগান। ভরসা দিন। শাকিরের ভালো কাজ ছড়িয়ে দেন। দেখবেন, শাকির দ্বিগুণ শক্তিতে জেগে উঠেছেন। মনে রাখবেন, শাকিররা জেগে উঠলে জেগে ওঠে কয়েক শ প্রাণ। সেই প্রাণগুলো ছড়িয়ে দিতে জানে আনন্দ। ছড়িয়ে দেয় হৃদয় নিংড়ানো নিরন্তর ভালোবাসা, যে ভালোবাসা এক সুতায় বেঁধে ফেলে আপামর এক জনগোষ্ঠীকে।

মানুষটাকে নিয়ে বড় বড় কথা লিখতে এতটুকুও দ্বিধা কাজ করেনি? না, করেনি। কেন করেনি, তার ছোট্ট একটা সতেজ উদাহরণ দিই—

একটা লোক পুরো মাস খেটে নামমাত্র সম্মানী পায়। আপনার কি তাকে নিয়ে বড় বড় কথা লিখতে ইচ্ছা করবে না, যখন দেখবেন মানুষটা সদ্য পাওয়া সম্মানীর পুরোটা দিয়ে বন্যার্তদের জন্য ত্রাণ কিনছেন। আপনি হলে পারতেন? আমরা তো মাসে হাজার হাজার টাকা কামাই করেও এমন দুর্যোগের সময় অসহায় মানুষকে একটু সাহায্য করতে অনীহা জানাই। এসবের জন্য তো দেশের সরকার আছেই। একটু মন খারাপই হয় শাকিরদের জন্য, তাঁরা অল্পস্বল্প বেতনের দোহাই দিয়ে কেন নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখতে পারেন না? কেন পারেন না?

নৌকায় ঘুরে বানভাসি মানুষের খোঁজ নিচ্ছেন শাহ সিকান্দর আহমদ
ছবি: সংগৃহীত

শ্রদ্ধার শাকির ভাই, আপনাকে নিয়ে আমার গর্ব হয়। কতবার দেখেছি বিধ্বস্ত হতে, কিন্তু নুইয়ে পড়েননি। আপনি আমাদের জন্য অনেক বড় শক্তি। আপনার পথচলায় সঙ্গী হয়ে রইব। জানি, বললেও খুব একটা আমলেই নেবেন না, তবু বলার জন্য বলছি, মাঝেমধ্যে নিজের খেয়াল রাখবেন, নিজের পরিবারের খেয়াল রাখবেন। আপনাকে ভালোবাসলে, আপনার কাজকে সাপোর্ট করলে, আমাকে/আমাদের যদি ‘সুবিধাবাদী’ শব্দটাকে বহন করে বাঁচতে হয়, তা–ই নাহয় হলো। আরও একবার বলতে চাই, আমি শাকিরের কাজকে ভালোবাসি। এখানে দ্বিমত পোষণ করার কোনো অবকাশ নেই।

ভালো থাকুন শাকিররা। শ্রদ্ধা ও অকৃপণ ভালোবাসা জানাই। একটা শহরে একা এক শাকির চাইলেও অনেক কিছু করে ফেলতে পারবেন না। আসুন, আমরা নিজেদের অবস্থান থেকে তাঁদের সহযোগিতা করি। দিন শেষে কিছু প্রাণ হয়তো বেঁচে থাকার প্রেরণা পাবে। এর চেয়ে মূল্যবান কিছু হতে পারে কি?

‘বন্ধরা সব আলো ছড়িয়ে দিক
সেই আলোয় আলোকিত হোক এই ধরা,
বাঁচুক ধরিত্রীপুর।’

বালুচর, সিলেট