আবার দুজনে

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

প্রথম মাসের বেতন হাতে পেয়েই আবিরের চোখ ভিজে গেল। অদ্ভুত একটা অনুভূতি কাজ করছে তার মনে। একসঙ্গে অনেক টাকা। তা–ও আবার নিজের পরিশ্রমের টাকা। জিবে আঙুল ভিজিয়ে টাকাগুলো বারবার গুনছে সে। প্রতিবার গুনে টাকার যোগফল সমানই হচ্ছে। তবুও টাকাগুলো গুনতে বেশ ভালো লাগছে তার। আকাশের দিকে তাকিয়ে আবির একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। আজ তার বাবা বেঁচে থাকলে অনেক খুশি হতেন। অফিস থেকে একটু আগেই বের হয়ে গেছে সে। মাকে দেখতে বাড়ি যাবে। টাকাগুলো প্যান্টের বাম পকেটে রেখে বাঁ হাত দিয়ে শক্ত করে ধরে রেখেছে। যেন কোনো ছিনতাইকারীও ছিনিয়ে নিতে না পারে।

আবির বাস থেকে পাঁচদোনা নেমে মায়ের জন্য কিছু ফল কিনল। সঙ্গে মোহন বাবুর সেই বিখ্যাত মিষ্টি। আবিরের মনটা আজ খুব ফুরফুরা। চোখ বন্ধ করে মায়ের মুখটা কল্পনা করতে চাচ্ছে। কিন্তু পারছে না। কখনো সে তার দুঃখিনী মায়ের মুখে হাসি দেখতে পায়নি। সবসময় দুশ্চিন্তার একটা প্রচ্ছন্ন আভা মায়ের মুখে দেখে সে বড় হয়েছে। এবার মায়ের দুঃখ কিছুটা ঘুচবে। সামনের ঈদ বোনাসের টাকা দিয়ে আবির মায়ের জন্য এক জোড়া কানের দুল গড়ে দেবে। বড় ভাই-ভাবি, ছোট ভাইবোনদের জন্য টুকটাক কেনাকাটা করবে। এসবই আবিরের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা।

আবির সিএনজিতে বসে আছে। সিএনজির পেছনে বাঁ পাশে বসে হাওয়া খেতে খেতে সে ঘোড়াশাল যাবে। পাঁচজন যাত্রী না হলে সিএনজি ছাড়বে না। আরও একজন লাগবে। মিনিট পাঁচেক পরে একজন বোরকা পরিহিত মহিলা এসেই পেছন থেকে একজনকে সামনের সিটে বসার জন্য ধমকের স্বরে আদেশ করল। ছাত্রগোছের এক বেচারা উঠে গিয়ে সামনের সিটে বসল। মহিলা আয়েশ করে ডানপাশের সিটে বসল। দেখে মনে হচ্ছে বেশ পর্দানশিন। আগাগোড়া সে কালো বোরকায় ঢাকা। চোখের সামনেও জালের মতো কাপড় ঝুলে আছে। আড়চোখে দু–তিনবার তাকাল আবির। সিএনজি চলছে দ্রুতগতিতে।

ঝংকার সিনেমা হলের সামনে আসতেই োই মহিলা ড্রাইভারকে বলল, ‘এই ড্রাইভার ভাই, একটু থামেন।’ সিএনজি থামার সঙ্গে সঙ্গে মহিলা খুব দ্রুত নেমে বাঁ পাশে এসে আবিরকে বলে, ‘এই বেটা তুই আরও চাপ। আমি বাম পাশে বসমু।’ বলার ঢং দেখে রীতিমতো ভয়ে আরও চেপে বসল আবির। এবার সে দু'জনের মাইনকা চিপায় গুটিসুটি হয়ে বসে আছে। বাঁ হাত দিয়ে বাঁ পকেটে রাখা টাকাগুলো বেশ শক্ত করে ধরে রেখেছে আবির। মহিলার আচরণ ও বেশভূষা দেখে তার সন্দেহ হচ্ছে। মহিলা কি ছিনতাই চক্রের কেউ? আবিরের এবার ডান পাশে বসা পুরুষটার চোখমুখ দেখে বোঝার চেষ্টা করছে সে–ও কি মহিলার সঙ্গের সদস্য কিনা? লোকটার মিটিমিটি হাসি দেখে আবির টাকাগুলো আরও শক্ত করে চেপে ধরে দোয়া ইউনুস পড়ছে। আল্লাহ আল্লাহ জিকির করছে।

আবিরের দিকে বারবার মহিলা তাকাচ্ছে। সিএনজির এত আওয়াজের ভেতরও আবির মহিলার হাসির ছলাৎ শব্দ শুনতে পায়। আবিরের কাছে মহিলার হাসিটা অত্যন্ত বিদঘুটে লাগছে। মনে হচ্ছে আলিফ লায়লার খারাপ আত্মা সোফান ইজবার মতো ডাইনি মার্কা হাসি! একপর্যায়ে মহিলা আবিরের বাঁ ঊরুতে ঠাস করে থাপ্পড় দিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘তুই কেমন আছিস?’ আবির আঁতকে উঠল। হতবিহ্বলতায় সে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি আমাকে কিছু বলছেন?’ মহিলা আবার পিঠে ঠাসঠুস করে ঘুষি দিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, তোকেই বলছি। জানিস, তোর জন্য বহুদিন ধরে অপেক্ষা করছি? অনেক দিন ধরে অপেক্ষা করছি রে, পাগলা। হা হা হা। বুঝলি কিছু? আজ তোকে বাগে পেয়েছি। আর যাবি কই?’ এইবার আবির নিশ্চিত হলো, সে নিশ্চিত মহাবিপদে পড়েছে। বড় একটা চক্রের কবলে পড়েছে। আজকাল পত্রিকা খুললেই এরকম অহরহ ঘটনা দেখা যায়। আবিরের বুকটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। সে থরথর করে কাঁপছে। সে জানে এমন সিচুয়েশনে জোরাজুরি করে লাভ হয় না। বরং বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে। তারচেয়ে ভালো সুন্দর করে কেঁদেটেদে বুঝিয়ে বললে হয়তো কাজ হতেও পারে।

তাই আবির মহিলার দিকে হাতজোড় করে বলল, ‘আপু গো, এটা আমার প্রথম মাসের বেতন। আমার অনেক দিনের ইচ্ছা এই টাকাগুলো মায়ের হাতে তুলে দেব। জানেন, আমার মা খেয়ে না খেয়ে অনেক পরিশ্রম করে আমাকে বড় করেছে। প্লিজ, আমাকে দয়া করুন। টাকাগুলো নিয়েন না।’ বলেই ডান হাতে মুখটা চেপে নিচু হয়ে আবির কাঁদতে শুরু করল। মহিলা এবার আরও উচ্চ স্বরে হাসছে। আবিরের কাছে সেই হাসি বিষের মতো লাগছে। মহিলাটা দ্বিগুণ মাত্রায় হাসতে হাসতে বোরকার নেকাবটা খুলে ফেলল। আবিরের হাতটা ধরে মহিলা বলল, ‘এই ভীতুর ডিম, তাকা আমার দিকে। নইলে কিন্তু তোর চোখ তুইল্লা নিমু।’

মুখ তুলে আবির মহিলার দিকে তাকিয়ে অপলক চোখে চেয়ে আছে। যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত! পাথরমূর্তির মতো হয়ে গেছে সে। শুধু অস্পষ্টস্বরে বলল, ‘মিথিলা, তুই!’ মিথিলা হাসছে। সেই কলেজজীবনে যেমন মাতাল হাসি হাসত, ঠিক তেমনই। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মতোই সে হাসির দ্যুতি ছড়ায় সিএনজি–জুড়ে। ‘জানিস, বাবার ব্যবসা গুছিয়ে গত সোমবার আমরা সবাই সৌদি আরবকে আল্লাহ হাফেজ বলে চলে এসেছি। সাথে এনেছি খুব সুন্দর একটা কম্বল। কারণ, আগামী শীতে আমাদের দুজনের মধ্যে যেন শীত বাধা হতে না পারে।’

সেই কলেজজীবনের মতোই দুজন আবার একসঙ্গে হাসছে। আবিরের মনে হচ্ছে সিএনজিটা আগের চেয়ে আরও দ্রুতগতিতে ঘোড়াশালের দিকে ছুটছে। ঠিক যেন পাগলা ঘোড়া। টগবগ টগবগ করে ছুটছে।

মাধবপুর, হবিগঞ্জ