আনিসুল হকের ‘মা’: এক কালজয়ী উপন্যাস

‘মা’ বইয়ের ১০০তম মুদ্রণের প্রচ্ছদ
ছবি: আব্দুল ইলা

লেখক আনিসুল হকের ‘মা’ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাস্তবকাহিনি অবলম্বনে রচিত একটি উপন্যাস। একজন আদর্শবান ও ইস্পাতদৃঢ় আত্মমর্যাদাবান মাকে কেন্দ্র করে এ উপন্যাসের পরিণতি লাভ করেছে। আর সে মা হলেন রত্নগর্ভা শহীদ আজাদের মা। আমাদের দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে অসংখ্য মর্মস্পর্শী, হৃদয়বিদারক ঘটনা রচিত হয়েছে। তেমনই একটি ঘটনা হচ্ছে শহীদ আজাদ ও তাঁর মায়ের ঘটনা।

আজাদের মা এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। অন্যদিকে আজাদের বাবা ছিলেন তখনকার টাটা কোম্পানির একজন ইঞ্জিনিয়ার। বিত্তশালী বাবা ইউনুস চৌধুরীর একমাত্র ছেলে মাগফার আহমেদ চৌধুরী আজাদ। মা সাফিয়া বেগমকে নিয়ে ইস্কাটনের রাজপ্রাসাদতুল্য বাড়িতে বেশ সুখেই কাটছিল তাঁদের দিনকাল।

কিন্তু বাবার দ্বিতীয় বিয়ে কালো মেঘ হয়ে আসে তাঁর মায়ের জীবনে। ইস্পাতকঠিন আত্মমর্যাদাসম্পন্ন সাফিয়া বেগম কিছুতেই স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ে মেনে নিতে পারেননি। তাই আজাদকে নিয়ে ইস্কাটনের বাড়ি ছেড়ে উঠলেন জুরাইনের এক খুপরি ঘরে। সেই থেকে শুরু হলো তাঁদের জীবনযুদ্ধ। অভাব-অনটন, দুঃখ-দুর্দশায় কেটে গেল কয়েক বছর। তবু ফিরে যাননি সেই প্রাসাদতুল্য বাড়িতে। হার মানেননি আজাদ, হার মানেননি তাঁর মা সাফিয়া বেগম।

এমনই সময় স্বাধীনতার ডাক দিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আজাদও এর মধ্যে এমএ শেষ করেছেন। সারা দেশের মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ল মুক্তিযুদ্ধে। দেশমাতৃকাকে রক্ষা করতে আজাদের মনও চাইছে যুদ্ধে যেতে। বারবার এ কথা মাকে বলতে চাইতেন তিনি, কিন্তু মায়ের অসহায়ত্বের কথা চিন্তা করে আর বলতে পারতেন না। প্রতিনিয়ত বিবেকের দংশনে প্রচণ্ডভাবে জর্জরিত হতেন।

একদিন সেই কথা বলেই ফেললেন মাকে। মা কী যেন চিন্তা করলেন! অবশেষে বললেন, ‘আমি কি তোকে শুধু আমার জন্যই মানুষ করেছি। এ দেশটাও তোর মা। যা দেশটাকে স্বাধীন করে আয়।’ মায়ের আশীর্বাদ নিয়ে আজাদ গেলেন মুক্তিযুদ্ধে। ঢাকার ক্র্যাক প্লাটুনের একজন গেরিলাযোদ্ধা ছিলেন আজাদ। মুক্তিযুদ্ধের মাঝখানে আগস্ট মাসে রাজাকারদের হাতে ধরা পড়লেন তিনি। হানাদাররা তথ্য জানার জন্য তাঁকে নির্মমভাবে নির্যাতন করত। নির্মম অত্যাচার-নির্যাতনের মুখেও আজাদ কিছুই বলেননি। তখন তাঁর মাকে বলা হয়, ছেলে যদি সবার নাম-পরিচয়, তথ্য বলে দেয়, তাহলে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হবে।

সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে ‘মা’ বইয়ের ১০০তম মুদ্রণ
ছবি: আব্দুল ইলা

তা শুনে আজাদের মা ছুটে গেলেন আজাদের কাছে। না, ছেলেকে মুক্ত করার জন্য নয়! বরং তিনি আজাদকে বললেন, ‘বাবা রে, যখন মারবে, তুমি শক্ত হয়ে থেকো। সহ্য করো। কারও নাম যেন বলে দিয়ো না।’ আজাদ মাকে কথা দিয়েছিলেন। বলেছিলেন জেলের দুর্বিষহ জীবনের কথা, প্রচণ্ড নির্যাতনের কথা। মাকে বলেছিলেন, ‘মা, ভাত খেতে ইচ্ছা করে। দুই দিন ভাত খাই না। কালকে ভাত দিয়েছিল, আমি ভাগে পাই নাই।’ আজাদের মা তাঁকে অভয় ও সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলেন, ‘আচ্ছা বাবা, কালকে আমি তোমার জন্য ভাত নিয়ে আসব।’

কথামতো ভাত নিয়ে এসেছিলেন মা। কিন্তু আজাদ চলে গিয়েছিলেন না ফেরার দেশে। আর কখনোই তিনি আজাদকে খুঁজে পাননি। আজাদের মা যাওয়ার পরপরই আজাদকে জেল থেকে সরানো হয়।

তারপর ১৪ বছর বেঁচে ছিলেন সাফিয়া বেগম। প্রতীক্ষায় ছিলেন তাঁর ছেলে ফিরে আসার। কিন্তু আজাদ আর ফেরেননি। আজাদের শোকে স্বাধীনতার পর যে কটা বছর বেঁচে ছিলেন, আর কখনো তিনি ভাত খাননি, হাঁপানি থাকা সত্ত্বেও কখনো খাটে ঘুমাননি। ঘুমাতেন মাটিতে, মাদুর বিছিয়ে। কারণ, তাঁর ছেলে মৃত্যুর আগে জেলে মাদুরে শুতেন।

১৯৮৫ সালের ৩০ আগস্ট মারা যাওয়ার আগেই তিনি বলে গিয়েছিলেন তাঁর কবরের ফলকে পরিচয় হিসেবে লিখতে ‘শহীদ আজাদের মা’। তাই আজও জুরাইনে একটি কবর দেখা যায়। যাতে লেখা ‘মোসা. সাফিয়া বেগম, শহীদ আজাদের মা’।

এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না, ‘মা’ বইটি পড়ে যাঁর চোখের পানি ঝরেনি। নিজের অজান্তেই টপটপ করে চোখ থেকে অশ্রু বেরিয়ে পড়ে। কথাসাহিত্যিক আনিসুল হকের ‘মা’ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলা সাহিত্যের এক কালজয়ী উপন্যাস।

বন্ধু, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভা