অস্বস্তি

অলংকরণ: আরাফাত করিম

হাসান রিতাকে নিয়ে শ্বশুরের বাসায় এসেছে। এটা তার শ্বশুরের নিজের বাড়ি। রিতা বাবার বাসায় প্রায়ই আসে। মাসে দু–তিনবার আসবেই। এটা রিতার নিয়মিত রুটিন। ওরা চার বোন এক ভাই। ভাই সবার ছোট। তিন বোনের বিয়ে হয়েছে। বড় আপার বাসা পাশেই, দুটো বাড়ি পরে। মেজ আপার বাসা কাছেই, হাঁটার রাস্তা। ওনারা হুটহাট করে চলে আসেন।

বড় দুলাভাই সরকারি চাকরি করেন, খুব আমুদে মানুষ। শ্যালিকার নিয়ে হইহুল্লোড়ে মেতে থাকেন। মেজ দুলাভাই ব্যবসা করেন, ভালোই তাল মেলাতে পারেন। কিন্তু হাসানের বেগ পেতে হয়, তার কাছে অস্বস্তি লাগে। সবাই একত্র হলে একেবারে গল্পের আসর বসে যায়, আর থামতে চায় না। যেহেতু আপাদের বাসা কাছেই, তাই তাদের ওঠার কোনো নাম থাকে না।

রিতাও এই বাসায় এলে আর উঠতে চায় না। যেদিন গল্প বেশ জমে উঠবে, সেদিন আরেকটু বসো, আরেকটু বসো করে রাত দশটা বাজাবে। তারপর বলবে, আজকে থেকেই যাই, কালকে অফিস করে আমাকে নিয়ে যেয়ো। গত তিন বছরে হাসান এটাই দেখে আসছে।

শনির আখড়ায় হাসানের ভাড়া বাসা। গ্রামের বাড়ি নরসিংদী তাই ওই এলাকায় থাকা। রাত এগারোটায় গেট বন্ধ করে দেয়। মুগদা থেকে শনির আখড়া এক ঘণ্টা লেগে যায়। আজকে গল্পের আসর বেশ জমে উঠেছে, সহজে ভাঙবে বলে মনে হয় না।

সময় বাড়তে থাকে আর হাসানের টেনশন বাড়তে থাকে। এখানে থেকে যাওয়ার কোনো উপায় নেই, কেননা সকালে অফিস আছে। প্রাইভেট ব্যাংকের চাকরি, ড্রেসকোড মেইনটেইন করে অফিসে যেতে হয়। হাসান আজ জিনসের প্যান্ট আর খয়েরি রঙের পাঞ্জাবি পরে এসেছে। এই ড্রেসে অফিসে যাওয়া সম্ভব নয়। অথচ আসার সময় হাসান রিতাকে জিজ্ঞেস করেছিল, আবার থেকে যাবে নাতো? ও বলেছিল, আরে না না, চলে আসব।

হাসান তাগাদা দেয়, রিতা তুমি উঠবে, না আমি চলে যাব? সেই একই পুনরাবৃত্তি, আর একটু বসো।
হাছান আস্তে আস্তে অস্থির হয়ে ওঠে। রুমের মধ্যেই পায়চারী করতে থাকে। মনে মনে বিড়বিড় করতে থাকে। ছোট শ্যালিকা মলি এসে বলে, দুলাভাই আপা আজ থাকুক। হাসান বলে, ঠিক আছে, তাহলে আমি গেলাম। রিতা এগিয়ে আসে, মলি তোর দুলাভাইকে খাবার দে।

হাসান কোনোমতে চারটি মুখে দিয়ে বেরিয়ে পড়ে।

সাড়ে দশটা বেজে গেছে। এত রাতে রিকশা যেতে চায় না। কিছু দূর হেঁটে রিকশা পেয়ে যায়। রিকশায় বসে মনে মনে রিতার চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করে। আরে বাবা তুমি থাকবা থাকো, তোমাকে কে থাকতে বারণ করেছে? আগেভাগে বলে দিলেই তো পারো?

বাসায় পৌঁছাতে এগারোটা দশ। গেট খোলাই ছিল। হাছান হাঁপ ছেড়ে বাঁচে, তিনতলায় উঠে পকেটে হাত দিয়ে দেখে চাবি নেই। ওর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। দর দর করে ঘামতে থাকে। আবার সে মুগদা যাবে? অসম্ভব। কিন্তু চাবিটা গেল কোথায়?

দুই সেট চাবি। এক সেট রিতার কাছে আর এক সেট ওর কাছে থাকে। সুতরাং ভুল হওয়ার কথা নয়, তা ছাড়া অফিসের ড্রয়ারের চাবিও একই সঙ্গে আছে।

হঠাৎ মনে এল, সামনের গলির টিনশেডের মেসে এক চাবিওয়ালা থাকে। হাসান দেরি না করে নেমে গেল। মোড়ের পান দোকান এখনো খোলা আছে। পান দোকানের রফিকের সহায়তায় চাবিওয়ালাকে পাওয়া গেল। চাবিওয়ালা এসে তালা খুলে দিল।

হাছান যখন বাসায় ঢুকল, তখন বারোটা দশ। মেজাজ সিক্সটি নাইন হয়ে আছে। পাঞ্জাবি খুলে ছুড়ে মারল ছোফার ওপর। প্যান্ট ছুড়ে মারলে ছোফার পাশে রাখা টি টেবিলের কাচের গ্লাসের ওপর গিয়ে পড়ল। খট করে একটা আওয়াজ হলো। হাছানের সন্দেহ হলো, আওয়াজটা কিসের? প্যান্ট তুলে ডান পকেটে হাত দিয়ে চিরুনি পেল। বাঁ পকেটে হাত দিয়ে দেখে ঘামে ভেজা রুমাল আর চাবি। হাসান ধপ করে সোফার ওপর বসে পড়ল।

যাত্রাবাড়ী, ঢাকা