অশ্রুভেজা আনন্দ

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

হারিকেনের মৃদু আলোয় সেলিনার চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়া অশ্রুবিন্দু স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে দূর থেকে। বিয়ের এক বছর পার না হতেই তার কোলজুড়ে আসে প্রথম সন্তান রায়হান। বছর দু–তিন পর জন্ম নিল ছোট মেয়ে লতা। খুব কষ্টের সংসার তার। কিছু টাকার বিনিময়ে মামা জোর করে বিয়ে দিয়েছেন পাড়ার এক অসৎ ছেলের সাথে। দেখতে খুব সুন্দরী ছিল সেলিনা। পড়াশোনায়ও ছিল বেশ ভালো। বাবা–মা মারা যাওয়ার পর মামির কাছে সে মানুষ হয়। তার মামা বড় লোভী মানুষ, আর তাই জোর করে তুলে দেয় নেশাখোর এক ছেলের হাতে।

নেশার ঘোরে প্রায়ই সেলিনাকে মারধর করত তার স্বামী। শত কষ্ট চাপা দিয়ে সেলিনা দিন কাটিয়ে নেয়। তবু তার কপালে সুখ জোটেনি। লতা জন্ম নেওয়ার এক বছর পর তার স্বামী পালিয়ে যায়। অনেক খোঁজের পরও তার আর দেখা মেলেনি। সেলিনার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। দুইটা ছেলে–মেয়ে নিয়ে কারও কাছে ঠাঁই পেল না। মহল্লার এক স্কুলমাস্টারের সহযোগিতায় গার্মেন্টসে একটি ছোট চাকরি জুটল সেলিনার। খুব সামান্য বেতনের চাকরি। দুটি ছেলে–মেয়ে নিয়ে না মরে বেঁচে থাকার মতো করে জীবন চলছে তার।

রায়হান স্কুলে যাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। ঘরের কাজে মাকে সাহায্য করে, আর ছোট বোন লতাকে দেখাশোনা করে। সেলিনা সকালবেলা বের হয়ে সন্ধ্যায় ফেরে। তাই রায়হানকে সবকিছু সামলাতে হয়। সেলিনার খুব মায়া হয় তার ছোট দুটি ছেলে–মেয়ের জন্য। তাদেরকে ভালো জামাকাপড় তো দূরে থাক, ভালো করে দুমুঠো খাওয়াতে পারছে না। হারিকেনের আলোয় বসে তাই সে কান্নায় ভেঙে পড়ে।

কয়েক দিন পর ঈদ। এখনো বেতন পায়নি সেলিনা। বাসায় নেই নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী। অথচ রায়হান বায়না ধরেছে নতুন জামা কিনে দেওয়ার জন্য। লতা অবুঝ মেয়ে, তবু তার মনেও স্বপ্ন জাগে নতুন জামা পরার। কীভাবে কী করবে, সেলিনা কূল খুঁজে পায় না। প্রতিদিনের মতো কাজ শেষ করে সেলিনা বাসায় ফেরার জন্য তৈরি হলো। হঠাৎ তার মনে হলো, ম্যানেজারের সাথে কথা বলে আগামী মাসের বেতন অগ্রিম নিয়ে নেবে। তাই সে ম্যানেজারের রুমে গেল। খুব অনুরোধ করে বলল তার প্রয়োজনের কথা। কিন্তু কিছুতেই মন গলাতে পারেনি তাঁর। হতাশ হয়ে বিষণ্ন মনে বাসায় ফিরল সেলিনা।

বাসায় এসে দেখল, লতা ঘুমিয়ে পড়েছে, রায়হান রান্না করছে। মাকে দেখে রায়হান বলে উঠল, ‘মা, জামা কবে কিইনা দিবা? সবাই তো জামা কিইনা ফেলাইছে। মাহিমের বাবা তাকে সুন্দর একটা পাঞ্জাবি কিইনা দিছে।’ রায়হানের কথায় সেলিনার বুক কেঁপে উঠল। আর্দ্র কণ্ঠে বলল, ‘তোমারেও কিইনা দিমু বাবা, একটু ধৈর্য ধরো। তুমি গিয়া লতাকে দেহ, আমি রান্না করছি।’ এই বলে সেলিনা রান্নার কাজে লেগে গেল। মুহূর্তে এক রাশ চিন্তা তাকে ঘিরে ফেলে। হঠাৎ তার মনে হলো অবসর সময়টুকু কীভাবে কাজে লাগানো যায়। তখনি মাথায় এল, কারও বাসায় গিয়ে রান্নার কাজ করবে। সে তো ভালো রান্না করতে পারে।

পরদিন সেলিনা গার্মেন্টসে গেল। সেখানে কয়েকজন সহকর্মীর সাথে আলোচনার সুবাদে একটি বাসায় রান্নার কাজ পেল। সন্ধ্যায় গিয়ে রান্না করতে হবে। সেলিনার মন আনন্দে নাচতে লাগল। বাসায় ফেরার সময় ঠিকানায় লিখা বাসাটি খুঁজে বের করল এবং রান্নার কাজে লেগে গেল। তার রান্নার স্বাদে বাসার সবাই মুগ্ধ। দুই দিন রান্না করার পর সেলিনা বাসার গিন্নিকে তার অবস্থার কথা জানাল। আর তখনি তিনি তাকে এক মাসের বেতন আগাম দিয়ে দিলেন। টাকা হাতে পেয়ে সেলিনার মনে হলো যেন আকাশের চাঁদ পেয়েছে। খুশিতে সে কাঁপতে লাগল। দ্রুত রান্না শেষ করে মার্কেটে চলে গেল। কতগুলো দোকান ঘুরে রায়হান ও লতার জন্য খুব সুন্দর দুটি জামা কিনে নিল। নিজের জন্য কিছুই কেনেনি। সে ভাবে, সন্তানের আনন্দই তার আনন্দ। তারপর সে বাসার পথে রওনা হলো।

তার আজ মনে হচ্ছে, বাসার পথ অনেক দূর! কখন সে বাসায় যাবে আর ছেলে–মেয়ের হাসিমুখ দেখবে, তার জন্য অস্থির হয়ে আছে। অবশেষে বাসায় পৌঁছাল সেলিনা। রায়হানকে জড়িয়ে ধরে বলল, এই দেখ, তোর জন্য কত সুন্দর জামা এনেছি। রায়হান নিজেকে যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। মায়ের হাত থেকে ব্যাগ নিয়ে তাড়াহুড়ো করে খুলে ফেলল। জামা দেখে সে আনন্দে নাচতে লাগল। মায়ের গালে চুমু খেল। তারপর সেলিনা লতাকে কোলে নিয়ে তার সামনে নতুন জামাটি নাড়াতে লাগল। অবুঝ মেয়ে লতা, তবু জামা দেখে সেও হাসে। হাত দিয়ে জামা টেনে ধরে খেলতে লাগল।

সেলিনার চোখ দুটি আনন্দে ছলছল করছে। মুহূর্তের মধ্যে তার সব কষ্ট দূর হয়ে গেল। মনে হলো পৃথিবীতে আজ সে সবচেয়ে সুখী মানুষ। আদরের টুকরা সন্তানগুলোকে বুকে চেপে ধরে অশ্রুবন্যায় ভাসতে লাগল সেলিনা। তার এই আনন্দাশ্রুর সাক্ষী যেন আকাশের তারারাও। মিটি মিটি হাসি নিয়ে তারাও জ্বলছে আকাশের বুকে।

ভাষাবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়