অভিমান

প্রতীকী ছবি।
প্রতীকী ছবি।

এক

১৪ ফেব্রুয়ারি। রুমের দরজা বন্ধ করে বসে আছি আমি। কিন্তু আমি জানি এই মুহূর্তে বাইরে কী হচ্ছে! আমাদের পাঁচ সদস্যের (অবশ্য বান্ধবী বলাই ভালো) ফ্ল্যাটটা গমগম করছে এখন। আমার রুমে ছিটেফোঁটাও নেই। তবে ভেতর থেকে বাইরের সবকিছু ঠিকই বোঝা যাচ্ছে।

স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি, আমার পাশের রুমের সেতু এইমাত্র গোসল সেরে এল। গামছা দিয়ে চুল ঝাড়ার সপাং সপাং শব্দ আসছে। সেতু কিন্তু প্রতিদিন এত তাড়াতাড়ি গোসল করে না। রুনু ঠোঁটে লিপস্টিক দিয়ে বারবার দুই ঠোঁট এক জায়গায় করছে আর মিনাকে ডাকছে। রুনু কিন্তু খুব বেশি লিপস্টিক দেয় না। ফাইজা জামা পরে দেয়ালে লাগানো আয়নাটায় বারবার দেখছে আর গুনগুন করে গান গাইছে। অথচ ওর কণ্ঠে গান আমি এ জন্মে শুনিনি। আর মিনা এখনো মোবাইলে ওপাশের কাউকে বলেই যাচ্ছে, ‘এই তো জান, আর একটু। এখনই নামছি।’ এ কথা কাকে বলছে সে–ও আমি জানি।

পড়াশোনার জন্য একই ফ্ল্যাটে থাকার সুবাদে আমরা একে অপরের প্রতিদিনের অভ্যাস আর চাওয়া-পাওয়া জানি। বগুড়া শহরের ফুলবাড়িতে আমাদের এই ছোট ফ্ল্যাটে সকাল হয় খুনসুটি করতে করতে। কিন্তু আজ আমি চুপচাপ। সবাই ব্যস্ত নিজেকে নিয়ে। আর আমার দরজা বন্ধ। তবে হলফ করে বলতে পারি, ওরা আজ কে কোন পোশাক পরেছে। একটু পরে কেন বাইরে যাবে!

আমি এ–ও জানি, যাওয়ার সময় ওরা প্রত্যেকে আমার ঘরের দরজায় কড়া নাড়বে। হাসিমুখে বিদায় নেবে। নিচে দাঁড়িয়ে থাকা প্রিয় মানুষদের নিয়ে আজ ওরা বগুড়া শহর চষে বেড়াবে। আর আমি ঘরে বসে চুপচাপ যা করছিলাম তা–ই করব! আজকের এই দিনে কান্না ছাড়া কীই–বা করার আছে আমার। তীব্র অভিমান কান্না হয়ে ঝরলে আমি কী করতে পারি। আমি কি আর অতশত বুঝি নাকি! সকালবেলা ও যখনই বলেছে আজ আসতে পারছে না, তখন থেকেই সেই যে অনবরত ঝরছে আর থামার নাম নেই। দূর ছাই এত পানি কই থাকে কে জানে!

দুই
আমার আর ওর—মানে অয়নের সম্পর্কের বয়স পাঁচ বছর। একটা প্রেমের সম্পর্কের সম্ভবত যৌবনকাল। যেহেতু আর বছর দুয়েক পরে বিয়ে করার পরিকল্পনা করছি, সেহেতু মনে হয় প্রেমের ইতি ঘটছে। কী জানি বাপু, বিয়ের পরেও নাকি জম্পেশ প্রেম করা যায়। আমিও অয়নকে বলে রেখেছি, পাঁচ বছর ধরে দূরে থেকে এই যে অপূর্ণতা তৈরি করেছে, এটা কিন্তু বিয়ের পর সুদে-আসলে শোধ দিতে হবে। অয়ন মাথা নেড়েছে। আমার মৌখিক চুক্তিপত্রে সই করেছে ঠোঁট দিয়ে। অবশ্য দূরই বা কোথায়। আমি পড়াশোনার জন্য বগুড়া শহরে। আর ও চাকরিসূত্রে ঢাকায়। অনার্স শেষ হলেই আমিও ঘাঁটি গাড়ব ঢাকাতেই। আর তো বছর দুয়েক মাত্র।

কিন্তু তাই বলে এই দিনে ও পাশে থাকবে না। আমি ওর হাতে হাত রাখব না। হুড খোলা রিকশায় ঘুরব না! টঙের দোকানে চা খেতে খেতে ঝগড়া করে বলব না, এর চেয়ে ঢের ভালো চা আমি বানাতে পারি।

এমন তো গত চার বছর হয়নি। ঠিক ঠিক ১৪ ফেব্রুয়ারির দিন হাজির হয়েছে আমার পাগলটা। আজও তো আসার কথা। অথচ সকালবেলা ঘুম ভাঙল ওর এসএমএস পেয়ে। ‘জান, অফিস থেকে ছুটি মেলেনি। রাগ কোরো না, প্লিজ। আমি দু–এক দিন পরই আসছি। ভালোবাসা দিবস তো আমাদের প্রতিদিনই। তাই না!’ কী পটানি কথাবার্তা। ওর কি ধারণা আমি এসবে ভুলে থাকব। কখনোই না। সকালেই দুজনের একপ্রস্থ হয়েছে। জানি না সারা দিন কী হবে। কিন্তু আমি কোনোভাবেই ভেবে পাচ্ছি না, কী করে কাটবে আমার আজকের দিন।

গতকাল রাতেও আমাকে বলেছে, কাল আসছি। তৈরি থেকো! কোন জামাটা আমার পরতে হবে সেটাও ও বলে দিয়েছে। নীল জামা আর লাল লেগিংস বের করে রেখেছি ওর কথামতোই। আজ আমরা কোথায় যাব, সেটাও ঠিক করা। দুপুরে মা ক্যাফেতে দুজন কোন চেয়ারটায় বসব! সব ঠিক করে রেখেছিলাম। অথচ আজ সকালেই ও সব ভন্ডুল করে দিল। প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে ওর ওপর। অবশ্য রাগারাগির ব্যাপারটা নতুন না আমাদের মধ্যে। খুনসুটি তো হয়ই। খুনসুটি সরিয়ে অভিমান ভাঙাতে দেরি করে অয়ন। কিন্তু আমি পারি না। ভেতরটা জ্বলেপুড়ে যায়। কিন্তু আজ যতই জ্বলুক। আমি ফোন দেব না। আমার চেয়ে ওর কাজই দামি হয়ে গেল! আজকের দিনে!

তিন
সন্ধ্যা সাতটার মধ্যে ফ্ল্যাটের সবাই ফিরল। এসেই সারা দিনের গল্পের ঝাঁপি খুলে বসল ওরা। আমার মন ভালো করে দিতে বেশ তৎপরতা দেখলাম ওদের। আমার ফুলে ওঠা চোখ, ভিজে দাগ হয়ে যাওয়া গাল, রাগে কামড়ে ধরা ঠোঁটের কাটা দাগ দেখতে দেখতে ওরা একটু অবাকই হলো। এমনটা কখনোই হয় না আমার। থাক সেসব, কিন্তু আজকের দিনে ওদের গল্প আমার কানে ঢুকছিল না। আমি হিসাব মেলাচ্ছিলাম অয়নের আজকের দিনে আমার কাছে না আসাটাকে। দিনে বেশ কবার ফোন দিয়েছে। ধরিনি। আমিও আমার হুতুমপেঁচা নম্বরে ডায়াল করতে গিয়ে করিনি।

এসব ভাবনা আর ওদের গল্প শুনতে শুনতে রাত হলো। খেতে ইচ্ছে করল না। সারা দিনও করেনি। ঘরে রাখা পাউরুটিতে জেলি মাখিয়ে কামড় দেওয়ার সময়ই গান ভেসে এল একটা। তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম! আমার ফোনের রিংটোন। ধরলাম। কেন ধরলাম বুঝতে পারলাম না। অবশ্য ওর ভয়েস না শুনে আমি ঘুমাতে পারি না গত পাঁচ বছর। কিন্তু আজ আমি চুপচাপ। আমার মাথা ঠিক হচ্ছে না কোনোভাবেই। কেন ও এল না আজ। কেন এমন করল আমার সঙ্গে। পাউরুটি আর খাওয়া হলো না। জানালা দিয়ে ছুড়ে ফেলে দিয়ে ফোন অফ করে কাঁদতে কাঁদতে বিছানায় গেলাম। কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না।

চার
১৫ ফেব্রুয়ারি। বাইরে তখনো সূর্য ওঠেনি। সবে ফাগুনের কুয়াশা কাটতে শুরু করেছে। আমার ঘুম ভাঙল রুনুর ডাকে। সকালবেলায়ই এমন দরজা ধাক্কানোর কোনো মানে হয়! আমি মেজাজ গরম করে দরজা খুললাম। চোখ ডলতে ডলতে রুনুর দিকে তাকাতেই বলল, ফোন অফ কেন তোর। ভাইয়া কথা বলবে ধর! ফোনটা হাতে দিয়ে ওর রুমে চলে গেল। আমি ফোন ধরে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠস্বর! আনিতা, একবার বারান্দায় আসবে। প্লিজ।

কেন যাব, কেন যাব করতে করতে বারান্দায় এলাম। দেখি আমাদের বাসার পাশ দিয়ে যাওয়া রাস্তার ওপাশে একটা ট্রাক দাঁড়ানো। আমি মেজাজ গরম করে বললাম, সমস্যা কি তোমার সকালবেলায়ই...কথা শেষ হওয়ার আগেই অয়ন বলে উঠল, তোমার সব রাগ নিয়ে যাওয়ার জন্য ট্রাক নিয়ে এসেছি! রাগগুলোকে একটু নিচে পাঠাবে, প্লিজ। বলতে বলতে ট্রাকের ওপাশ থেকে কেউ একজন বেরিয়ে এল। কালো চাদরের পুরো অবয়ব দেখে আমি চমকে গেলাম। অয়ন। এই সকালবেলা। আমার চোখে আবার জল এল। সেটা লুকানোর জন্য আমি রুমে ঢুকে গেলাম। অয়ন আমার ফোনের ওপাশে কথা বলেই চলছে, শোন না আনিতা। একটু শোন না!

লেখাটি প্রথম আলো বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের প্রকাশনা ‘তারুণ্য’–এর অষ্টম সংখ্যা (ফেব্রুয়ারি ২০১৯) থেকে নেওয়া।

বন্ধুসভায় লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]