অব্যক্ত ভালোবাসা

প্রতীকী ছবি
অলংকরণ: তুলি

আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ক্লাস। ক্লাসে যেতে যেতে বেশ দেরি হয়ে গেল। ক্লাসের দরজার সামনে প্রায় পাঁচ ফুট উচ্চতার একটি মেয়ে খোলা চুলে দাঁড়িয়ে আছে। তার দিঘল কালো চুল কোমর ছাড়িয়েছে। এক নিমেষেই এ চুলের প্রেমে পড়া যায়। আপাতত প্রেমে পড়া সম্ভব হচ্ছে না। মাথায় অন্য চিন্তা কাজ করছে। মেয়েটা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে কেন? ক্লাসেই–বা ঢুকছে না কেন? স্যার ক্লাস থেকে বের করে দিয়েছেন নাকি? মেয়েটাকে আগে জিজ্ঞেস করে নেওয়া যাক, কেন সে ক্লাসে না ঢুকে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। ওর কাছে গিয়ে ক্লাসে না ঢোকার কারণটি জিজ্ঞেস করলাম। সে কোনো উত্তর দিল না। আমাকে পাশ কাটিয়ে হনহন করে চলে যেতে লাগল। আমার খুব রাগ হলো। আবার ওকে জিজ্ঞেস করলাম, উত্তরটা দিলে কি তোমার পার্টস থেকে কিছু টাকাপয়সা আমার পকেটে চলে আসত? আশ্চর্য, এবারও কোনো উত্তর পেলাম না!

ভার্সিটিতে প্রায় ছয় মাস শেষ হতে চলল। এই ছয় মাসে আমি ছয় দিনও ক্লাসে মনোযোগ দিতে পারিনি। আমার মনোযোগজুড়ে ছিল প্রথম দিন দেখা হৈমন্তী নামের সেই মেয়েটি। ক্লাসে কারও সঙ্গেই ওকে কথা বলতে দেখিনি। গাড়ি করে ক্লাসে আসত আবার ক্লাস শেষ হলে সোজা গাড়িতে গিয়েই উঠত। মেয়েটা কি গাড়ি, বাড়ি, ক্লাস ছাড়া আর কিছুই চেনে না!

হৈমন্তী এক সপ্তাহ ধরে ভার্সিটিতে আসছে না। একটানা এত বেশি ক্লাস ও মিস দেয়নি কখনো। আমি আমার অ্যাটেনডেন্সের হিসাব না রাখলেও হৈমন্তীরটা রেখেছি সব সময়। মেয়েটা ক্লাসে আসছে না কেন? ব্যাপার কী? ওর জন্য মনের মধ্যে কেমন জানি একটা টান অনুভব করলাম। যে মেয়েটা আমার কথার উত্তর না দিয়ে ভাব ধরে চলে গিয়েছিল, ও রকম একটা অহংকারী মেয়ের প্রতি আমার এত টান কিসের, বুঝলাম না। আমার রাতগুলো নির্ঘুম হয়ে গেল, চিন্তাভাবনাজুড়ে বসত নিল শুধু হৈমন্তী। আমি বুঝতে পারলাম, আসলে নিজের মনের অজান্তেই আমি ওর প্রেমে পড়েছি। বন্ধু আবিদের কাছ থেকে হৈমন্তীর বাসার ঠিকানা নিলাম। ঝিগাতলায় ওদের বাসা। খুঁজে পেতে কোনো সমস্যা হলো না। দুবার কলবেল বাজার পর একটা অল্প বয়সী ছেলে দরজা খুলে দিল। ওর নাম মিঠু। বাসার কাজের ছেলে। মিঠু আমাকে জিজ্ঞেস করল,

—কারে চান ভাইজান? কই থেকে আসছেন? আপনার নাম কী?

—একটা একটা করে প্রশ্ন করতে পারো না? এতগুলা প্রশ্নের উত্তর যদি আমি একসাথে দিই, তাহলে কি তুমি মনে রাখতে পারবে?

—কী কন না কন ভাইজান! আমি সব মনে রাখতে পারি। শুধু আটা, ময়দা ছাড়া। আম্মায় আমারে আটা–ময়দা আনতে পাঠাইলে আমার মনে থাকে না। আটা আনতে কইল, নাকি ময়দা আনতে কইল...।

ছেলেটা বেশি কথা বলে। আমি ওকে কোনোমতে থামিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

—হৈমন্তী আছে? আমি ওর ক্লাসমেট। নাম শোভন। ওকে একটু ডেকে দাও।

—আপা তো অনেক ব্যস্ত। আইজকাই চইলা যাইব তো। তাই ব্যাগ গুছাইতাছে এখন।

হৈমন্তী স্কলারশিপ নিয়ে কানাডা চলে যাচ্ছে। আজকেই ওর ফ্লাইট। মিঠুর কাছ থেকেই এসব জানলাম। মিঠু আমাকে ড্রয়িংরুমে বসতে দিয়ে ভেতরে গেল। একটু পর হৈমন্তী এল। ওর মায়াবী মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলাম কিছু সময়ের জন্য। ও আমাকে হাত ইশারা করতেই আমি সংবিৎ ফিরে পেলাম। হৈমন্তী আমাকে বসতে বলল, কী খেতে চাই জানতে চাইল। সবই ইশারায়, একটা কথাও ওর মুখ থেকে বের হলো না। আজকের এই বিদায়বেলায়ও কি হৈমন্তী কোনো কথা বলবে না। আমার খুব রাগ হলো ওর ওপর। আমি হৈমন্তীর ওপর রেগে গেলাম। রেগেমেগে ওকে জিজ্ঞেস করলাম,

—এই, তুমি বোবা নাকি? কথা বলতে পারো না? বারবার ইশারা করছ কেন?

আমার কথায় হৈমন্তী চুপ হয়ে গেল। একটু থেমে গিয়ে ও আমাকে ইশারায় যা বোঝাল সেটা আমি কোনো দিনও বুঝতে চাইনি। হৈমন্তী কথা বলতে পারে না। ও বোবা। আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। মনে মনে বললাম, আসলে তুমি বোবা নও হৈমন্তী। বোবা হচ্ছি আমি। গত ছয়টা মাস শুধু তোমাকে দেখেই কাটিয়েছি। একবারের জন্যও তোমার সামনে এসে কথা বলতে পারিনি সাহস করে। ওদের বাসা থেকে বের হতেই শ্রাবণের বৃষ্টির কবলে পড়লাম। এ মুহূর্তে বৃষ্টি অনেক প্রয়োজনীয় ছিল। কারণ, বৃষ্টি ছাড়া আর কোথাও কান্না লুকানো সম্ভব নয়।