অবেলায় বেলা ফুরোলো

প্রতীকী ফাইল ছবি।
প্রথম আলো

হোস্টেলে থাকি। ভার্সিটি বন্ধ হওয়ায় আজ বাড়ি যাচ্ছি। বাস চলছে প্রায় ২০ মিনিট ধরে। বাসের পেছনের আসনে বসেছি মায়ের কথা রাখতে। পেছনে বসলে নাকি ঝুঁকিমুক্ত থাকা যায়। বাসে বসার পর স্বভাবতই জীবনে ঘটে যাওয়া অনেক ভালো–মন্দ গল্প মনে পড়তে থাকে। সেসব গল্প নিজের অজান্তে ঠোঁটের একপাশে হাসির রেখা টেনে দেয়। আবার অনেক সময় মনের গহিন জায়গাটা কালো করে দেয়। তবে আজ দুটি পিচ্চিকে দেখে সময় ভালোই যাচ্ছে। ছোট থাকার মজা অনেক। বড় হলে হাসি–আনন্দ থাকে ঠিকই, তা–ও কোথাও একটা পানসে অনুভূতিও জন্ম নেয়।
ভাবনার জগতে হঠাৎই ছেদ পড়ে প্রচণ্ড জোরে একটা শব্দের পর। আমার বাসের সঙ্গে একটা মালবাহী ট্রাকের ধাক্কা লেগেছে। ধাক্কাটা মারাত্মক ছিল। যার ফলে বাসের সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল। ছিটকে পড়ল সবাই চারদিকে। বাসের এক পাশ পুরো চ্যাপ্টা হয়ে গেছে। আমি বেশ জোরেই আঘাত পেলাম মাথায়। মনে হয়েছিল আর বোধ হয় জীবন ফিরে পাব না। বারবার মনে প্রশ্ন জাগছিল, ‘এখানেই কি আমার সমাপ্তি?’
এরপর জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম। বেশ কিছুক্ষণ পর জ্ঞান ফিরল। বাইরে মানুষের কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। অ্যাক্সিডেন্ট এলাকার মানুষ ওরা। এখনো পুলিশ বা ফায়ার সার্ভিস আসেনি। এর মানে আমি জ্ঞানহীন অবস্থায় কয়েক মিনিটের বেশি ছিলাম না। বাসের ভেতরটা পুরো মুচড়ে গেছে। বীভৎস অবস্থা। কে কোনটা বোঝা যাচ্ছে না। অনেকে এখনো বেঁচে আছে। গোঙানির শব্দ এখনো শোনা যাচ্ছে অনেকের। চারদিকে শুধু রক্ত আর রক্ত।

আশ্চর্যজনকভাবে আমার একটুও ব্যথা হচ্ছে না। পুরো সুস্থ লাগছে। তাই আস্তে আস্তে ভাঙা জানালা দিয়ে বেরিয়ে এলাম। কয়েক পা হাঁটার পর মনটা নাড়া দিয়ে উঠল। আমি চলে যাচ্ছি সুস্থ আছি বলে, আর বাসের ভেতরে ওরা যে পড়ে আছে অসহায়ের মতো। ওরাও তো বেরিয়ে আসতে চাইছে ওই মৃত্যুপুরী থেকে। ওদের তো সাহায্যের প্রয়োজন। ওদের সাহায্য করা উচিত আমার।
আচ্ছা, আমার পাশের সিটে বসা দু–তিন বছরের ছোট্ট শিশুটি, যে কিনা বারবার তাকাচ্ছিল কৌতূহলী চোখে আমার দিকে, আর বারবার হেসে হেসে মুখ লুকোচ্ছিল মায়ের বুকে। সে কী অবস্থায় আছে এখন, বেঁচে আছে তো?
আর সেই ছেলেটা, যে সদ্য নবম শ্রেণিতে উঠেছে। আজ বাবার হাত ধরে ভালো একটা স্কুলে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি ফিরছিল। চোখেমুখে তার আনন্দের ঝলকানি। খুশি যেন ঠিকরে পড়ছিল তার চেহারা থেকে। মুখ থেকে হাসি মিলাচ্ছিলই না। ওর হাসিতে যেন অসম্ভব এক শান্তি লুকিয়ে ছিল। শিশুদের মতো ওর বাবাকে বলছিল, ‘দেখে নিয়ো বাবা, আমি একদিন ভার্সিটির প্রফেসর হবই হব।’ কথাগুলো শুনে তার বাবার মুখে প্রশান্তির হাসি ছড়াচ্ছিল। ছেলেটাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছিল খুব ভালো পড়াশোনায়। কি জানি কোন অবস্থায় আছে সে।
ইতিমধ্যে অনেককেই উদ্ধার করেছে স্থানীয় লোকজন। আমি আস্তে আস্তে বাসে ঢুকলাম, আর খুঁজতে থাকলাম পিচ্চি দুটোকে। হঠাৎ চোখ পড়ল একটা ছোট্ট হাতের ওপর। হাতটার মধ্যে ছোট কাচের তিনটে চুড়ি। কিন্তু দেহটা নেই হাতটার সঙ্গে। আমার চিনতে দেরি হলো না, ভাঙা চুড়ি আর আর ছোট্ট হাতটা যে ওই পিচ্চিটার। যে আমাকে ২০ মিনিটেই ওর মায়ায় ফেলে দিয়েছিল। হাউ মাউ করে কেঁদে উঠব, ঠিক তখনই চোখ পড়ল ভাবী প্রফেসরের দিকে। নিচে শুয়ে আছে। নীরব হয়ে। ওর বাবুই পাখির মতো কথাগুলো চুপ হয়ে গেছে। গোলাপি রঙের গালটা থেঁতলে আছে। কিন্তু হাতের সেই অ্যাডমিট কার্ড হাতেই রয়ে গেছে। ওইটা সে ছাড়েনি। রক্তে ওর সাদা শার্টটা ভরে গেছে। নিজেকে আর পারলাম না ঠিক রাখতে। হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলাম। কী নির্মম পরিহাস। এমন দৃশ্য মেনে নেওয়া সহ্যশক্তির বাইরে। মানুষ এত স্বপ্ন, এত ইচ্ছা অপূর্ণ রেখে কীভাবে মরে যায়? ওরা কত ছোট। এত ইচ্ছা–আশা নিয়ে কীভাবে অকালে ঝরে পড়ে? কীভাবে?

পারলাম না দাঁড়িয়ে থাকতে। বেরিয়ে এলাম। বেরোতেই দেখি হাতবিহীন সেই পিচ্চিটার লাশ মাটিতে। মানুষ একেক করে লাশ বের করে সারিবদ্ধভাবে রাখছে। হঠাৎই একটা লাশের দিকে তাকিয়ে আমার সারা পৃথিবী স্তব্ধ হয়ে গেল। বুঝে উঠতে পারছিলাম না কিছুই। এটা কীভাবে সম্ভব? আমি তো এখানে! তাহলে মাটিতে ওটা কে? আমার পোশাক, আমার হাতঘড়ি, দেখতেও হুবহু আমার মতো! মাথায় আঘাতের চিহ্ন।
বাসে তো তাকে দেখিনি! তাহলে সে কে?
ধীর পায়ে কাছে গেলাম। লাশটা স্পর্শ করলাম। কিন্তু পারলাম না স্পর্শ করতে। পানিতে যেভাবে হাত দিলে তা আবার অনায়াসে বের হয়ে আসে, কোনো বাধা পায় না, ঠিক তেমনি ওর মাংস বা হাড়ের মধ্যে কোনো বাধা না পেয়ে আমার হাতটা অনায়াসে ফিরে এল। ধরতে পারলাম না তাকে। আমি অদৃশ্য নাকি এই মেয়েটা অদৃশ্য, সেটা বোঝার জন্য আরেকটা লাশ ধরলাম। কিন্তু পারলাম না ধরতে। বুঝতে বাকি রইল না আমি যে মৃত। আমি আর মানুষ নেই। ডুকরে কেঁদে উঠলাম। কত ইচ্ছা কত স্বপ্ন ছিল আমার। কত রাত জেগে পড়েছি বড় হব বলে। কিন্তু হলো না সেসব পূরণ।
মৃত্যু কখন কার জীবনে আসবে আর সব স্বপ্নের ইতি ঘটাবে, সেটা বোঝা বড় দায়।
এতক্ষণ পিচ্চি দুটির জন্য কেঁদেছিলাম। অবেলায় বেলা ফুরিয়ে গিয়েছিল ওদের। তখন বুঝিনি আমারও যে অবেলায় বেলা ফুরিয়ে গেছে।

সিলেট বন্ধুসভা