অবেলার সুখ

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

লোকে বলত আমি নাকি রাজটিকা নিয়ে জন্মেছি। কথাটার মানে বুঝতাম না তখনো। অনেক ছোট ছিলাম তো!
অদ্ভুত ব্যাপার কি জানেন? ওই রাজটিকা শব্দটার মানে বুঝে ওঠার আগেই না ওই লোকগুলোর কথার মোড় ঘুরে গেল। একটা সময় ওরা বলতে শুরু করল আমার ভাগ্যে নাকি খারাপ নজর লেগেছে। বাজে নজর আবার কি জিনিস? এই কথাটাও আমার ছোট্ট মাথায় ঢুকত না।
আমার জীবনে মাত্র সাতটি বসন্ত পাড়ি দিয়েছিলাম স্বপ্নের মতো। আব্বু, আম্মু আর আমি, এই তিনজন মিলে সারাক্ষণ হাসি আনন্দে বিভোর থাকতাম। আব্বু আর আমি তো সব সময় আম্মুর সঙ্গে মজা করতাম, খ্যাপাতাম। আম্মুর খেপে যাওয়ার স্বভাব ছিল, যা আমরা দুজন বেশ জমিয়ে উপভোগ করতাম।
জ্ঞান হওয়ার পর থেকে কান্না কাকে বলে বুঝিনি। কেন জানি কাঁদতে হয়নি আমায়। কাউকে কাঁদতে দেখলে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতাম। আমার কৌতূহল দমাতে না পেরে আম্মুকে জিজ্ঞেস করতাম ‘আম্মু! চোখ দিয়ে পানি কীভাবে পড়ে?’ আম্মু বলত, বড় হলেই বুঝতে পারব। তাই আমিও বড় হওয়ার অপেক্ষায় থাকতাম।
প্রতিদিন সকালবেলা আমার ঘুম ভাঙত আম্মুর চুমুতে। আর বাবার ঘুম ভাঙত আমার চুমুতে। তারপর শুরু হতো কাতুকুতুর পালা। সকালবেলা অবশ্য আমি আম্মুর দলের বিশ্বস্তজন হিসেবে কাজ করতাম। তখন আমরা দুজন মিলে আব্বুকে ঘুমাতে দিতাম না। যতভাবে পারা যায়, ততভাবে আব্বুকে জ্বালাতাম। আমাদের প্রতিটি সকাল–দুপুর–রাত এভাবেই স্বর্গীয় সুখে কেটে যাচ্ছিল দারুণ।

কিন্তু হঠাৎ একটা সকাল কেমন জানি এলোমেলো হয়ে এল, আর সেই থেকে সবকিছু এলোমেলোই রয়ে গেল। আটটি বসন্তের শেষের দিকে একটি সকালে আমার ঘুম ভাঙল আব্বুর চিৎকার শুনে।
তাকিয়ে দেখি পাশে আম্মু শুয়ে আছে, আর আব্বু পাগলের মতো আম্মুকে ডেকে চলেছে। আব্বুর এত চিৎকার, আর্তনাদেও আম্মুর কোনো সাড়া নেই।
ওই দিন প্রথম আব্বুকে কাঁদতে দেখেছিলাম। আব্বুর কান্না দেখে আমার গালেও কান্না ঝরছিল অঝরে। এর আগেও তো অনেককে কান্না করতে দেখলাম, কই? তখন তো আমার এমন হয়নি? তাহলে আজ আব্বুর চোখের পানি আমাকে বিভ্রান্ত করছে কেন?
আম্মু বলেছিল বড় হলে বুঝব কীভাবে চোখে পানি আসে। তাই বারবার আম্মুকে বলেছিলাম, ‘আম্মু দেখো! আমি বড় হয়ে গেছি, আমার চোখে পানি আসছে!’ আমার কথাতেও সেদিন সাড়া দেয়নি আম্মু। আর ওই দিনটি থেকেই আমার কান্নার সঙ্গে সখ্য শুরু।
সেদিন থেকেই আমি বড় হয়ে যাই, অনেক বড়। পেটে ব্যথা করলেও কাউকে জ্বালাই না, পুতুল খেলি না, আবোলতাবোল কথা আওড়াই না।
লুকোচুরি খেলায় মত্ত আম্মু, তাই আমি বাচ্চা স্বভাব বাদ দিয়ে আম্মুকে খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি কল্পনায়। আমার যাযাবরের জীবন শুরু হয় আম্মু চলে যাওয়ার পর দিন থেকেই।

আজ ১০টি বসন্ত পাড়ি দিলাম আম্মুহীন যাযাবর অবস্থায়। ওই দিনের পর থেকে সকালবেলা আমার গালে কেউ চুমু খেত না। তাই আমিও বাবার গালে চুমু খেয়ে ঘুম ভাঙাতাম না। আব্বুকে কাতুকুতুও দিতাম না। আব্বু আর আমার মধ্যে বিস্তর দূরত্ব চলে আসে না চাইতেই।
এই দূরত্বটা কাটিয়ে উঠতে আব্বু সপ্তাহের এক দিন আমাকে নিয়ে লং ড্রাইভে যেতেন। ঠিক আগে যেভাবে আমরা তিনজন যেতাম ছুটির দিনে, ঠিক সেভাবে। কিন্তু লাভ হতো না কিছুই। সপ্তাহের এক দিন আমি আব্বুকে কাছে পেতাম, তাঁর মজার মজার কথা শুনতাম। ভেতরে থাকা চাপা কষ্টকে কবর দিয়ে আমাকে হাসানোর প্রাণপণ যুদ্ধ চলত আব্বুর মনে। আমি বুঝতে পারতাম সেটা, কিন্তু হাসিটা যেন কোথায় চাপা পড়ে গিয়েছিল। হাসি আসত না আমার। পাশের শূন্য সিটের দিকে তাকালে খাঁখাঁ করত মনে। ‘বেশ তো ছিলাম! এখন কেন এত শূন্যতা?’ এসব ভাবতে ভাবতে হুট করেই কান্না জুড়ে দেওয়া অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছিল তখন।
আব্বু ভাবতেন বাসায় সারা দিন একা থাকব, বিষণ্নতায় ভুগব, তাই বাসায় থাকতে দিতেন না। স্কুল ছুটির পর আজ ফুফুর বাসা, কাল খালার বাসা আর পরশু নানুর বাসা। এভাবেই কাটতে থাকে দিনরাত, আম্মুর মনমতো সাজানো আমার থাকার ঘরটাকে ছেড়ে।
যত দিন আম্মু ছিল, তত দিন আমার চারপাশে ভালোবাসা ছিল। কিন্তু আম্মুর অনুপস্থিতি পাল্টে দিল সব। করুণা, দয়া, সমবেদনার বাণী আর চাহনিতে যেন ছেয়ে গেল আমার চারদিক।
নানুর বাসায় এত্ত বড় মামাটা যখন নানুর আদর খেত, আমার বুকের মধ্যে তখন চিনচিনে ব্যথা করত। আমি কাউকে বলতে পারতাম না সে ব্যথার কথা। কারণ এই ব্যথাটা আগে কখনো হয়নি আমার। একদম নতুন সব অনুভূতির সঙ্গে পরিচিত হতে লাগলাম ধীরে ধীরে।

বাসায় কয়েক দিন পরপর এসে দেয়ালে টানানো আম্মুর বড় ছবির সামনে দাঁড়িয়ে থাকতাম মধ্যরাতে। ওই ছবিতে আম্মুকে আমার কাছে জীবন্ত মানুষ লাগত, এখনো লাগে।
সময় পাল্টায়, মানুষ পাল্টায়, সঙ্গে ভালোবাসার মধ্যে থাকা আবেগটাও পাল্টায়। এখনো আম্মুর ছবির সামনে আসি। তবে এখন আর পাগলের প্রলাপ বকি না। শুধু তাকিয়ে থাকি, আর বুকের মধ্যে চিনচিনে সেই ব্যথাটাকে আপন করতে ব্যস্ত থাকি।
আগে দিনের বেলা আম্মুর ছবির দিকে তাকাতে ভয় লাগত। বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে যেতাম অশ্রু আটকাতে না পেরে। কাঁদতে দেখলে যে কেউ সান্ত্বনা দিতে ছুটে আসত। আর সেই সান্ত্বনাটুকু আমার খুব অসহ্য লাগত। সান্ত্বনা পেয়ে লাভ নেই বুঝে গিয়েছিলাম তত দিনে। কারণ সান্ত্বনা, সমবেদনা, দয়া—কোনো কিছুই আমার মায়ের শূন্যতা পূরণ করতে পারবে না।
কেন জানি আম্মুকে এখন আমার অবেলার সুখ বলে মনে হয়। আম্মুর ছবির সঙ্গে কথা বলতাম। অভিমানী কণ্ঠে কথা আটকে যেত বারবার। তা–ও বলে যেতাম। কখনো কখনো অভিমান ভুলে খুব করে বলতাম ফেরত চলে আসার জন্য, আমার ভালো লাগছে না আর। কিন্তু আম্মু আসত না। কথা বলার একপর্যায়ে মধ্যরাতে মাঝেমধ্যেই ঘাড়ে কারও হাতের স্পর্শ পেতাম।
ওই স্পর্শে চমকে উঠতাম না একদম। ‘আম্মু হয়তো কথা রেখেছে’ ভেবে খুশি হয়ে পেছনে তাকাতাম। কিন্তু না, আম্মু আসত না কখনো। অশ্রুসিক্ত চোখে আব্বুকেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতাম সব সময়।
আমাদের পৃথিবী নিশ্চুপ হয়ে গেছে অনেক আগেই। সেখানে সময়ের রং পাল্টে গিয়েছিল। আজ অবধি সে রঙে পরিবর্তন আসেনি। কারণ, আম্মুটাই যে আসেনি আর। আমরা দুটো মানুষ আজ অবধি আম্মুর অস্তিত্বহীনতায় আক্রান্ত, সময়ের ব্যবধানে আবেগটাই শুধু শক্ত হয়েছে মাত্র।
সে সময় মধ্যরাতে আম্মুর ছবিকে ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকতাম দুজন। কোনো কথা হতো না তখন, কেউ কাউকে সান্ত্বনার বাণীও ছুড়তাম না। তা–ও বিষণ্নতা যখন তার সীমা অতিক্রম করত, নীরব মনোযুদ্ধে যখন পেরে উঠতাম না। তখন একজন আরেকজনকে জাপটে ধরে শুধু কান্নাই বিনিময় করতাম।
সেই মুহূর্তে অন্ধকার রাত যেন দুটো মানবের আর্তচিৎকারে ভারী হয়ে উঠত নিস্তব্ধে। সাক্ষী থাকত রাতের ঘুটঘুটে অন্ধকার আর নীরবতা।