জাফরের সঙ্গে আমার পরিচয়টা একটু বাজেভাবেই হয়। এক দিন দুপুরে একটু শুয়েছিলাম, চোখটা লেগে এসেছে এমন সময় ফোন এল ইন্টারকমে। ঘুম আমার সব সময়ই প্রিয়। ঘুমের সময় কেউ বিরক্ত করলে খুব রাগ লাগে।
প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে আমি ফোনটা ধরলাম। খুব কম বয়সী একটা কণ্ঠ সালাম দিয়ে বলল, ‘আমি আপনার নিচের ফ্লোরে থাকি, খুব শব্দ হয় আপনাদের বাসায়, একটু খেয়াল রাখবেন।’
খুব মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। মনে পড়ল দুপুরে হাত থেকে বড় স্টিলের গামলাটা পড়ে গিয়েছিল। বেশ আওয়াজও হয়েছে। কিন্তু কি এমন হয়েছে যে ফোন দিয়ে কমপ্লেইন দিতে হবে? বয়স হয়েছে, এখন আগের মতো নেই, একটু শক্ত হাতে কিছু ধরতে পারি না, অঘটন ঘটে যায়।
আমি আয়েশা, একান্নতে পা দিয়েছি, স্বামী মারা গেছেন অনেক আগে। একটাই ছেলে দিহান, দেশের বাইরে থাকে।
আমি এখানে একাই থাকি... ঠিক একা না, শিউলি আছে। ছোটবেলা থেকেই আমার কাছে আছে মেয়েটা। ছেলে অনেক চায় তার কাছে চলে যাই। কিন্তু যেতে ইচ্ছে করে না। এই ফ্ল্যাটটা আমার জন্যই কিনেছে ছেলে। দুই মাস হলো উঠেছি।
এখনো অনেক এলোমেলো, গোছানো হয়নি পুরো। প্রতিদিন আমি আর শিউলি মিলে একটু একটু করে সাজাই।
ছেলেকে ভিডিও কল দিয়ে দেখাই। ছেলে এখন আর জোর করে না বিদেশ যেতে, বুঝে গেছে মা এভাবেই ভালো আছে।
আশপাশে আত্মীয়স্বজন তো আছেই।
বাজারসদাই শিউলি অথবা দারোয়ান দিয়ে করাই, মাঝেমধ্যে শিউলির সঙ্গে আমিও যাই। বাসায় এভাবে থাকতে ভালো লাগে না। তাই বাজারে যাই, মাছ কিনি, তাজা সবজি কিনি নিজে দেখে। কথা বলি দোকানওয়ালার সঙ্গে।
সেদিনও বাজারে যাচ্ছিলাম। লিফট তিনতলায় এসে থেমে গেল। লাঠিতে ভর দিয়ে ষাটের কাছাকাছি একজন উঠলেন। লাঠি ব্যবহার করার মতো বয়স বা শারীরিক অবস্থা তার নয়, তবে বোঝা যাচ্ছে লাঠি উনি ব্যবহার করছেন অনেকটা শখে। লাঠিটা বেশ সুন্দর। আমার দাদাশ্বশুরের কাছে দেখেছিলাম এমন একটা লাঠি। অনেক শৌখিন ছিলেন তিনি। ওই সময়ে লন্ডন থেকে এনেছিলেন।
আমার দিকে তাকিয়ে ভদ্রলোক হেসে বললেন, ‘আপনি চারতলায় থাকেন? আমি আপনার নিচতলায় থাকি।’
একটু অবাক হলাম। ভেবেছিলাম সেদিন কোনো কম বয়সী ছেলেপুলে হবে। উনাকে দেখে একটু লজ্জাই পেলাম।
এমন বয়সে অনেক সমস্যা হয়। সবচেয়ে বেশি হয় ঘুমের। ওপরতলায় শব্দ হলে তো সমস্যা হতেই পারে।
অপরাধী সুরে বললাম, কিছু মনে করবেন না, বয়স হয়েছে, আর আমার হাতে একটু সমস্যা আছে, শক্ত করে কিছু ধরতে পারি না। মাঝেমধ্যে এটা–ওটা পড়ে যায় হাত থেকে, শব্দ হয়।
আমার কথা শেষ না হতেই উনি উচ্চস্বরে হেসে বললেন, আমি কিন্তু সেদিন ইন্টারকমে কণ্ঠ শুনে কোনো তরুণী ভেবেছিলাম।
খুব লজ্জা পেয়ে গিয়েছিলাম সেদিন, শিউলির সামনে সেটা ঢাকতেই আর কথা বাড়াইনি।
এরপর মাঝেমধ্যেই দেখা হতো। বিকেলে আসরের নামাজটা পড়ে এক কাপ চা নিয়ে চলে যেতাম ছাদে। উনিও বিকেলে ছাদে আসতেন। উনি অবশ্য আসতেন অন্য কারণে। ছোট্ট একটা বাগান করেছেন। সেটার যত্ন করতেন, পানি দিতেন। ১০ তলা বিল্ডিংয়ের ছাদে বিকেলে শুধু আমরাই যেতাম, আর কেউ নয়। সব কিছু কেমন যেন বদলে গেছে। এখন আর কেউ ছাদে, খোলা বাতাসে আসে না। বাচ্চারা বুঁদ হয়ে থাকে গ্যাজেটে, তাদের মা–বাবা কফিশপে অথবা ঘরোয়া আড্ডায়। বিকেলের রোদ গায়ে মাখার সময় এখন কারও নেই। অথচ আমাদের সময় বিকেলটা ছিল মধুর। একসঙ্গে বসে সারা দিনের গল্প, বাচ্চাদের মুক্তির আনন্দ, খেলাধুলা, ছোটাছুটি, কি দারুণ ছিল দিনগুলো।
কথায় কথায় জানতে পারলাম জাফর রিটায়ার্ড আর্মি অফিসার। বউয়ের সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়েছে অনেক আগে।
একটাই ছেলে। চাকরির কারণে ঢাকার বাইরে থাকে। মাঝেমধ্যে ফোনে বাবার খোঁজ নেয়। দেখেও যায় কালেভদ্রে। এই ফ্ল্যাটটা উনি কিনেছেন অবসরের পর। বাগান করে, বই পড়ে, পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে সময় কাটে।
‘এখন আর বেশি ভাবি না, বাঁচবই আর কতদিন’ জাফরের কথায় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলি।
আজকাল মাঝেমধ্যে আমি রান্না করি। দিহান যদিও জানে না। জানলে খুব রাগ করবে। শিউলিকে অনেক বকবে।
শিউলিকে কড়া করে বলে দিয়েছি, ভুলেও যেন না জানে দিহান। রান্না করে শিউলিকে দিয়ে কিছু খাবার পাঠিয়ে দিই জাফরের জন্য। একা মানুষ, একজন মেয়ে এসে সবকিছু করে দিয়ে যায়। তবু কি দিয়ে কি রান্না করে! জানি এই বয়সে অনেক খাবার মানা, তবু অনেক যত্ন করে মাছের মাথাটা মুগডাল ও পুঁইশাক দিয়ে চিংড়ি অথবা কুমড়ো ফুলের বড়া ভেজে পাঠিয়ে দিই।
জাফর মজা করে বলে, ‘আয়েশা সেই পঁচিশে কেন তোমাকে দেখিনি?’ আমার ভীষণ লজ্জা লাগে, অন্যদিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসি।
ভিডিওকলে দিহান, শিউলিকে এক চোট বকে এখন আমার সঙ্গে কথা বলছে। শিউলিকে বকেছে, এটার কারণ এই না যে সে কোনো অপরাধ করেছে। এটা দিহান করবেই। মাকে ঠিকমতো ওষুধ দিয়েছে কি না? মসলা কম দিয়ে রান্না করছে? মা ঠিকমতো ঘুমাচ্ছে? বাজারে কেন গেল মা? এই সব। এই সময় শিউলিকে বাঁচাতে সবকিছু নিজের কাঁধে নিই। বলি, ‘আমিই তো ইচ্ছে করে গিয়েছি বাজারে, ওর কি দোষ।’
এ কথা–সে কথার পর ফোন রাখার আগে দিহান বলল, ‘মা জাফর আঙ্কেল পাস্তাটা পছন্দ করেছিল?’ ছেলের মুখে এমন কথা শুনে খুব অপ্রস্তুত হয়ে যাই। দিহান মিটিমিটি হাসছে। ছেলের এই হাসি আমার চেনা। নিশ্চয়ই তিন্নি বলেছে। তিন্নি দিহানের বউ। এই যুগের মেয়ে, শাশুড়ির সঙ্গে খুব ফ্রি কথা বলে। সে দিন যখন তিন্নির কাছে পাস্তা রান্নাটা জানতে চেয়েছিলাম দুষ্ট হাসি দিয়ে বলেছিল, ‘কার জন্য মা? জাফর আঙ্কেলের জন্য?’ নির্ঘাত তিন্নি দিহানকে বলেছে কিছু, কী লজ্জা ছেলের সামনে!
আমি উত্তর দেওয়ার আগেই দিহান হেসে বলল, ‘মা তুমি আঙ্কেলের সঙ্গে বাগান করলেই পার, সময় কেটে যাবে।’ আমি চুপ করে ছিলাম, কিছু বলিনি। ছেলের এই কথার মানে আমার জানা, মায়ের এই একাকিত্ব সে বোঝে।
সেদিন বিকেলে দুই কাপ চা নিয়ে ছাদে বসে আছি, জাফর গাছে পানি দিচ্ছে। জাফরকে বললাম, ‘আপনি সব গোলাপের চারা লাগান কেন?’
‘অন্য কিছু পছন্দ নাকি? বললে সাতসমুদ্র পার হয়ে সেটাই নিয়ে আসব?’
আবারও লজ্জায় ফেলে দিল জাফর। কিছু বলতে তাঁর মুখে আটকায় না। লোকটা এই বয়সে এত দুষ্ট ও রসিকতা জানে, কম বয়সে না জানি কী ছিল? চায়ের কাপ হাতে নিয়ে আমার পাশে সিমেন্টে বাঁধানো বেঞ্চে বসতে বসতে জাফর বলল, ‘ওই গাছটা দেখ আয়েশা, নতুন এনেছি, কলি এসেছে। খুব সুন্দর একটা লাল গোলাপ ফুটবে ওতে।’
ওই রাতেই জাফর খুব অসুস্থ হয়ে গেল, শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। উপায় না দেখে শিউলিকে সঙ্গে করে বাসা তালা দিয়ে জাফরকে নিয়ে হাসপাতাল চলে এলাম। দিহান ফোনে ওর ডাক্তার বন্ধুকে বলে দিয়েছে। ডাক্তার দেখে বলল রাতের মধ্যে অবস্থার উন্নতি না হলে সকালে আইসিইউতে রাখতে হবে।
এর মধ্যে আমি জাফরের ফোন থেকে উনার ছেলের নাম্বার বের করে কল দিয়ে জানালাম। সেও পৌঁছে যাবে সকাল নাগাদ। জাফরের আরও কয়জন আত্মীয়কে জানালাম। রাত বাড়ছে। হাসপাতালে আসার পর থেকে একমুহূর্তও জাফরের কাছ থেকে দূরে যাইনি। শিউলি এসে এক কাপ চা দিয়ে গেল। কাপ হাতে আমি জাফরের দিকে শূন্য
দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। আজ বিকেলেও মানুষটা কী হাসিখুশি ছিল! কত গল্প করছিল!
শেষ রাতে জাফর মারা গেল। এর মধ্যে পুরো সময়টা আধো ঘুম, আধো জাগরণে ছিল সে। একবার শুধু চোখ মেলে আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসেছিল। ডাক্তার মৃত্যু নিশ্চিত করার পর আবারও রণকে ফোন দিলাম, বুঝলাম তার আসতে এখন অনেক দেরি। রণর সঙ্গে কথা বলেই জাফরকে বাড়ি নেওয়ার জন্য অ্যাম্বুলেন্সে তুললাম।
আমার সামনে জাফর, সাদা কাপড়ে ঢাকা পুরো শরীর। চোখের সামনে এত কাছের মানুষকে হারিয়ে যেতে দেখেছি!
প্রথমে চলে গেল মা–বাবা, তারপর দিহানের বাবা। মৃত্যু আমাকে আর এখন কাঁদায় না।
জাফরকে নিয়ে যখন বাসায় আসলাম সকাল হয়ে গেছে। অনেক মানুষের সমাগম আমাদের এই ছোট্ট কম্পাউন্ডে।
যারা জীবিত জাফরকে দেখতে আসেনি কোনো দিন, তারা মৃত জাফরকে বিদায় দিতে এসেছে। জাফরের আগের স্ত্রীও এসেছে। মরে গেলে নাকি মানুষ সব অপরাধের ঊর্ধ্বে চলে যায়। তাই হয়ত! শিউলি আর আমাকে নিচে থাকতে দিল না। সেই সন্ধ্যা রাত থেকে না খাওয়া, ওষুধ কিছুই হয়নি।
জাফরের জানাজার পর লাশ আরও একবার আনা হলো বাসার নিচে। অনেক বছর এখানে থেকেছেন, সবাই উনাকে শেষ দেখা দেখতে চায়। আমার খুব ইচ্ছে ছিল, মুখটা শেষবারের মতো দেখব। কিন্তু কী আশ্চর্য ! কেউ আমাকে ডাকল না। আমি ভেবেছিলাম রণ অন্তত ডাকবে। কারণ, তার বাবার খবর আমিই তাকে দিয়েছি। কিন্তু রণ যেন দেখেও দেখল না। শুধু একবার ভদ্রতা করে বলেছিল, ‘থ্যাঙ্ক ইউ আন্টি।’ আর এত মানুষের মধ্যে আমি আর জাফর পর্যন্ত যেতে পারিনি। জোর করে বলতেও পারিনি আমি তাকে দেখতে চাই।
গ্রামের বাড়ির উদ্দেশে জাফরকে নিয়ে লাশ বহনকারী গাড়িটা বের হয়ে গেল। আমি সেদিকে তাকিয়ে রইলাম।
জাফরের চারপাশের সবাই যেন আমাকে বুঝিয়ে দিল ওর ওপর আমার কোনো অধিকার নেই। এমনকি জাফরের সাবেক স্ত্রী, যার সঙ্গে সেই অনেক আগেই সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেছে, সেও কোনো এক অজানা অধিকার নিয়ে সঙ্গে গেল। আমি ছাদে জাফরের করা ছোট্ট বাগানের পাশে দাড়িয়ে তাকে বিদায় জানালাম। অধিকারহীনতার এক নিদারুণ অসহায়ত্ব ঘিরে ধরল আমাকে।
অধিকার হয়তো রক্তের সম্পর্কে হয়, বাবা-ছেলে, মা-ছেলে, ভাইবোন। রক্তের সম্পর্কে অধিকার খাটানো যায়।
দিহানের বাবার কাছে আমি কোনো দিন অধিকার নিয়ে কিছু চাইতে পারতাম না। দিহান যেমন জোর করে বলত,‘বাবা আমার এটা চাই’, একটা দাবি থাকত ওর কথায়। আমি কোনো দিনও এমন জোর দিয়ে বলতে পারতাম না,‘আমার তোমার কাছে সময় চাই, একটা বিকেল চাই, হাত ধরে কৃষ্ণচুড়ার ছায়ায় বসতে চাই, অনেক গল্প করতে চাই।’
দিহানের বাবা ভালো মানুষ ছিলেন। আমার কি লাগবে, না লাগবে সব খোঁজই রাখতেন। শুধু মনের খোঁজটা হয়তো নিতে পারেনি কখনো।
আচ্ছা, তবে কী অধিকার শব্দটা শুধু রক্তের সম্পর্কেই প্রযোজ্য? যদি তা–ই হবে, জাফরের সাবেক স্ত্রীরও অধিকার নিয়ে জাফরকে শেষ বিদায় জানাতে চলে গেল! শুধু পারলাম না আমি। এই কয় মাস এত কাছে থেকেও কোনো অধিকার জন্মায়নি আমার? হয়তো অধিকার খাটানোর মতো কোনো সম্পর্কই ছিল না তাঁর সঙ্গে।
যেটা ছিল তা শুধু মায়া! বিকেলে একসঙ্গে চা খাওয়া, ছাদের গাছগুলো যত্ন করা, যত্ন করে জাফরের জন্য রান্না করা, এমন অজস্র মায়া আমি বুকে জমিয়েছি এই কয় মাসে! মায়ার সম্পর্কে অধিকার খাটানো যায় না।
তাই হয়তো অধিকার নিয়ে আমি বলতে পারিনি শেষবারের মতো জাফরকে দেখব, আমিও যাব শেষ ঠিকানায় তাকে রেখে আসতে।
ছাদে চায়ের কাপ হাতে বসে আছি। পরিবেশটা খুব নীরব। এখনো একটা চুমুকও দিইনি চায়ে। আমি ভাবছি সম্পর্কের জটিল সমীকরণের, অধিকারের বেড়াজালে অনেক কথা না বলা থেকে যায়। নিঃসঙ্গ পৃথিবীতে নিঃসঙ্গই থেকে যায় মানুষ। এই আমি, আবারও একা হয়ে গেলাম। একটা সময় ভাবতাম পঞ্চাশের পর মৃত্যুর জন্য দিন গোনা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই। সেই ভাবনাটা ভুলে গিয়েছিলাম কিছুদিনের জন্য।
বাজার থেকে বেছে বড় কাজলি মাছ এনেছিলাম আজ দুপুরে বেগুন দিয়ে রেঁধে দেব বলে। মাছটা পড়ে রইল ফ্রিজের কোনায়। বেগুনগুলোও রান্না ঘরের ঝুড়িতে।