বলিষ্ঠ কণ্ঠ আজও অনুপ্রেরণা জোগায়

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে ভাষণ দিচ্ছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানছবি: সংগৃহীত

‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশা আল্লাহ।’ ছোটবেলা থেকে এই ভাষণ শুনেই বড় হয়েছি। প্রতিবছর আজকের এই দিনে প্রথম প্রহর থেকে মাইকে বাজানো হয় বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণটি। যে ভাষণ শুনে জেগে উঠেছিল সেদিন সাত কোটি মানুষ।

আজ ৭ মার্চ। ইতিহাসের একটি অনন্য দিন। আজ থেকে ৫৩ বছর আগে ১৯৭১ সালের এই দিনে বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ কণ্ঠে উজ্জীবিত হয়েছিল রেসকোর্স ময়দানের লাখো মানুষ। ৩ মার্চ পল্টনের ছাত্রসমাবেশে ঘোষণার পর জাতির জীবনে ৭ মার্চ আসে রাজনৈতিক আন্দোলনের পটভূমি থেকে। বেলা ১১টা থেকে রেসকোর্স ময়দান জনসমুদ্রে পরিণত হয়। রিকশা, বাস, পায়ে হেঁটে, যে যেভাবে পেরেছে, সেভাবেই অংশ নিল সেদিন। জায়গা না পেয়ে কেউ কেউ গাছের ওপরে উঠে পড়েছিল।

তিনি স্বপ্ন দেখতেন বাংলার মানুষের জন্য, আমৃত্যু চেষ্টা করেছেন দেশের উন্নতি করার জন্য। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও মার্টিন লুথার কিংয়ের ‘আই হ্যাভ আ ড্রিম’ যেন একই পথের পথিক।

সেদিন দুপুরে শেখ ফজিলাতুন্নেছা বঙ্গবন্ধুকে বললেন, ‘তুমি কারও কথায় প্রভাবিত হবে না। যা বিশ্বাস করো, তা-ই বলবে।’ বঙ্গবন্ধু সেটাই করেছিলেন। তিনি কোনো লিখিত বক্তব্য দেননি। যা বলেছেন সবটাই ছিল তাঁর মনের কথা, বিশ্বাসের কথা। ভাষণজুড়েই ছিল দেশকে নিয়ে ভাবনার কথা, দেশের মানুষের কথা, স্বাধীনতার কথা।

বক্তৃতায় তিনি ভাষা আন্দোলনের পটভূমি, সামরিক আইন প্রত্যাহার, ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে টালবাহানা, নিরস্ত্র বাঙালির ওপর অত্যাচার-হত্যার কথা উল্লেখ করে ইয়াহিয়ার ডাকা জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগ দেওয়ার জন্য চারটি শর্ত দিলেন।
শর্তগুলো হলো—
* সামরিক আইন তুলে নিতে হবে।
* সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিতে হবে।
* নিরস্ত্র জনতার ওপর গুলিবর্ষণের তদন্ত করতে হবে।
* জনগণের প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।

শর্তগুলো একদিকে যেমন ছিল অধিকার আদায়ের, অন্যদিকে ছিল পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ। ভাষণটি শোনার সময় খেয়াল করেছি, তাঁর প্রতিটি শব্দচয়ন, কণ্ঠস্বরের ওঠানামা, শরীরী ভাষা, বাচনভঙ্গি—সবকিছুই ছিল গোছানো, অভিনব। পুরো ভাষণে একবারের জন্যও মনোযোগ হারাইনি।

বলিষ্ঠ কণ্ঠে তিনি যখন বললেন, ‘মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশা আল্লাহ।’ তখন গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। মাঠজুড়ে ছিল নীরবতা, লাখো মানুষ একাগ্রচিত্তে শুনেছিল প্রতিটি শব্দ। ৭ মার্চের ভাষণ যে আলোর মশাল জ্বালিয়েছিল, সেই আলোর পথে বীর বাঙালি পৌঁছেছে স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে।

তিনি যে কী পরিমাণ দূরদর্শী ছিলেন, সেটা তাঁর ভাষণের দিকে নজর দিলেই টের পাওয়া যায়। একদিকে তিনি উল্লেখ করেছেন, ২৩ বছরের করুণ ইতিহাস, ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৫৪-এর নির্বাচন, ছয় দফা, ’৭০-এর নির্বাচন, স্বাধীনতাকামী মানুষের কথা। অন্যদিকে যুদ্ধ করার কৌশলও শিখিয়ে দিয়েছেন এভাবে, ‘তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে।’

৭ মার্চের ভাষণটির তুলনা করা যায় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী লর্ড পিটস, মার্টিন লুথার কিংয়ের ভাষণের সঙ্গে। আর আব্রাহাম লিংকনের বিখ্যাত গেটিসবার্গ ভাষণের সঙ্গে। আব্রাহাম লিংকন গেটিসবার্গে বর্ণবাদের বিরুদ্ধে যখন ভাষণ দিয়েছিলেন, তখন গেটিসবার্গ ও তার আশপাশের পরিবেশ পরিস্থিতি ঝুঁকিপূর্ণ ছিল না, যতটা ঝুঁকিপূর্ণ ছিল সেদিনের ৭ মার্চের ভাষণ। একপ্রকার বলা যায়, শত্রুর এলাকায় বসে জনগণকে আহ্বান করেছিলেন শুত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার। কতটা সাহস, তেজোদীপ্ত মনোভাব, দৃঢ়চেতা হলে এই কাজ করা যায়; এখন হয়তো তা কল্পনা করা যায় না। তিনি স্বপ্ন দেখতেন বাংলার মানুষের জন্য, আমৃত্যু চেষ্টা করেছেন দেশের উন্নতি করার জন্য। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও মার্টিন লুথার কিংয়ের ‘আই হ্যাভ আ ড্রিম’ যেন একই পথের পথিক। ১৯৭১ সালের এপ্রিল নিউজ উইক ম্যাগাজিন তাদের কভার স্টোরিতে বঙ্গবন্ধুকে ‘পোয়েট অব পলিটিকস’ বলে আখ্যায়িত করে। সেই ১৯ মিনিটের ভাষণে প্রকাশ পায় বঙ্গবন্ধুর সৃজনশীলতা, সবাইকে জাগিয়ে তোলার এক জাদুকরি মন্ত্র।

৭ কোটি মানুষকে এক করতে ৭ মার্চের ভাষণ বিশেষ ভূমিকা পালন করে। সেদিন তাঁর ভাষণের মতোই পরে ৭ কোটি মানুষকে দাবিয়ে রাখা যায়নি, বীর বাঙালি ছিনিয়ে এনেছেন স্বপ্নের স্বাধীনতা। ৭ মার্চের বলিষ্ঠ কণ্ঠের ভাষণ আজও অনুপ্রেরণা জোগায়।

বন্ধু, ভৈরব বন্ধুসভা