প্রেয়সী,
প্রথম পরিচয়ের দিনটি আজও চোখের সামনে ভাসে। যেন সন্ধ্যার আকাশে হঠাৎ জ্বলে ওঠা প্রথম তারাটির মতো, তুমি এসেছিলে আমার অচেনা জীবনে। ভিড়ভাট্টার শহরে তোমার চোখের দৃষ্টি ছিল এক অনাবিল নদীর মতো শান্ত অথচ গভীর। দুজনই হয়তো বুঝেছিলাম, সময়ের বুকে ভেসে চলা মানুষ আমরা হঠাৎই একই ঘাটে নোঙর ফেলেছি।
শুরু হলো মধুর সম্পর্কের দিন। হাসি জমত কাগজের চিঠিতে, চোখে আঁকা হতো নীলচে আকাশ, কানে বাজত অদৃশ্য বেহালার সুর। ছোট্ট চায়ের দোকান থেকে শুরু করে শহরের সেতুর নিচে বসে ভিজে কাগজের মতো স্বপ্ন লিখতাম। মনে হতো, পৃথিবীটা শুধু দুজন মানুষকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হচ্ছে।
ধীরে ধীরে ঘর বাঁধার স্বপ্ন জেগে উঠল। দুজনই চাইতাম একটি জানালাবিশিষ্ট ঘর, যেখানে সকালের আলো ঢুকবে, সন্ধ্যার আকাশে প্রদীপ জ্বলবে। কিন্তু বাস্তব তো কখনো কবিতার মতো সরল হয় না। চারপাশের মানুষ, সমাজের দেয়াল, সম্পদের গর্ব আর ধনীদের কংক্রিটচাপা আইন—সব মিলিয়ে আমাদের পথ রুদ্ধ হতে শুরু করল।
তোমার পরিবার চেয়েছিল বিলাসের উঠানে বসাতে তোমাকে। তারা বলল, প্রেম দিয়ে সংসার হয় না, হয় সম্পদ দিয়ে। আমাদের স্বপ্নের ঘরটা ভেঙে গেল নির্মম যুক্তির হাতে। তুমি আমার হাত ছাড়তে বাধ্য হলে। বুঝেছিলাম, একটা আলপিন এসে ফুটো করে দিল আমাদের ভালোবাসার বেলুনকে। যে বেলুন আকাশ ছুঁতে চেয়েছিল, সে নিশ্বাস হারিয়ে নিস্তব্ধ মাটিতে পড়ে রইল।
তোমার বিয়ে হলো এক ধনাঢ্যের সঙ্গে। ঝলমলে আলোয় সাজানো গয়নার মতো রাত, উজ্জ্বল অট্টালিকার ভেতর বন্দী হলে তুমি। বাইরে থেকে দেখলে মনে হয় যেন সব সুখ—শাড়ির রং, গাড়ির চকচকে বডি, অতিথিদের করতালির গর্জন। কিন্তু আমি জানতাম, হৃদয়ের ভেতর কারাগারের নীরবতা কতটা অসহ্য।
বছর গড়িয়ে গেল। আমি থেকেছি আমার নীরবতার আশ্রমে। মাঝেমধ্যে শুনতাম তোমার জীবনের গল্প—সুখ-অসুখের মিশ্রণ। মানুষ ভাবে, ধনীদের জীবনে দুঃখ আসে না, অথচ তোমার চোখের জল প্রমাণ করেছিল—স্বর্ণখচিত দেয়ালও অশ্রু আটকাতে পারে না।
অবশেষে আবার দেখা হলো এক অচেনা দুপুরে। ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিলে তুমি, কিন্তু তোমার চোখের ভেতর ছিল শূন্যতার ছায়া। আমরা দুজনই বুঝলাম, সময় অনেক কিছু কেড়ে নেয়, কিন্তু প্রথম পরিচয়ের দীপ্তি কখনো পুরোপুরি মুছে যায় না।
হয়তো আমরা আবার এক হতে পারব না, হয়তো সমাজ তার ইস্পাতের খাঁচায় আজীবন আটকে রাখবে আমাদের। কিন্তু আজ চিঠি লিখছি এই বিশ্বাসে যে, ভালোবাসা কেবল দুজন মানুষের সীমা নয়, এটি মানবতার বড় রূপ। যদি কখনো সমাজ বদলায়, ধনসম্পদের দেয়াল ভেঙে যায়, তবে হয়তো নতুন প্রজন্মের চোখে আমাদের মতো হাজারো প্রেমিক-প্রেমিকা মুক্ত আকাশে উড়তে পারবে।
আমাদের বেলুন হয়তো বিদ্ধ হয়েছিল আলপিনে, তবু সেই ক্ষণিক উড়ান, সেই অমলিন স্মৃতি—মানুষকে শেখাবে, প্রেম কোনো পাপ নয়, প্রেম দরিদ্রতার দাস নয়। প্রেমই মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ।
এই চিঠি শেষ করছি। কাগজ ভিজে উঠেছে, কলম থেমে আসছে। বিশ্বাস রাখো, একদিন সমাজ বদলাবে। কোনো ভালোবাসার বেলুন আর আলপিনে বিদ্ধ হবে না।
ইতি,
তোমার হৃদয়ে দাগ কাটা প্রেমিক। যে মোমের মতো আলো দিয়ে নিজেকে পোড়ায়।
টঙ্গী কলেজ গেট, গাজীপুর