কাজল স্যার
ধমক দিয়ে বললেন, ‘হনে হয়্যিদে আঁই বিড়ি হাই? আঁই বিড়ির ধুঁয়া ভিত্রে ন ঢুহাই। বুইজ্জস না ভোঁতা হাট্টল?’
আমার জীবনে কাজল স্যারের ভূমিকা অনেক। স্যার পড়ানোর ফাঁকে প্রায়ই চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় তাঁর চিরপরিচিত ট্রেডমার্ক কিছু বাণী বলতেন। যেগুলো তাঁর সব শিক্ষার্থীর জীবনে গভীর দাগ রেখে গেছে।
এখনো একাডেমিক পড়াশোনার কোনো লাইন না বুঝলে মনের অজান্তেই বলে ফেলি, ‘ভডর গরি ইবে কইত্যুন আইস্যে!’ শিক্ষার্থীদের পড়ানোর সময় যখন শুনি, ক্যালকুলাস শুরু করেছে! তখন মুখ ফুটে বের হয়ে যায়, ‘ত্রিকোণমিতি না পড়াই ক্যালকুলাস পড়ায় ফেলছে। পাগল নাকি তোদের টিচাররা?’
স্যারের ‘বিসমিল্লাহ ফর্মুলা’, ‘বর্ডার’, ‘আগে মাথায় পরে খাতায়’ ডায়ালগগুলো তো এখন নিত্যদিনের বচন হয়ে গেছে। কাজল স্যার একজনই। সারা চট্টগ্রামে স্যারের বিকল্প কখনোই হবে না।
স্যার প্রায়ই একটা কবিতা আবৃত্তি করতেন,
‘মহাবিশ্বের অমৃত বাণী,
গণিতকে করেছে বিজ্ঞানের রানি,
গণিতকে যে করে না ভয়,
গণিত তাহার সঙ্গে কথা কয়।’
ফাঁকিবাজ স্টুডেন্ট ছিলাম। তবু কখন যে স্যারের সান্নিধ্যের মোহে পেয়ে বসেছে, নিজেই বুঝে উঠতে পারিনি। আমার জীবনের পরম সৌভাগ্য, স্যারের স্নেহের ছায়াতলে একটু স্থান পেয়েছিলাম।
স্যারের সঙ্গে শেষবার দেখা হওয়ার স্মৃতিচারণা করি আজ। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর গিয়েছিলাম স্যারের সঙ্গে দেখা করতে। স্যার তখনো স্বভাবসুলভ সিগারেট হাতে। বললাম, ‘স্যার, সিগারেটটা ছাড়তে পারলেন না।’ ধমক দিয়ে বললেন, ‘হনে হয়্যিদে আঁই বিড়ি হাই? আঁই বিড়ির ধুঁয়া ভিত্রে ন ঢুহাই। বুইজ্জস না ভোঁতা হাট্টল?’
কথাবার্তা শেষে শেষবেলায় স্যারকে আমন্ত্রণ জানালাম প্রিয় ক্যাম্পাসে, ‘স্যার, আমার ক্যাম্পাসটা কিন্তু খুব সুন্দর। একদিন বেড়াতে আসেন!’ হঠাৎ গম্ভীর হয়ে জবাব দিলেন, ‘বয়স শেষদিকে। এখনো দেশটা ঘুরাঘুরি করা হইল না রে, সিয়াম। তোরা তো আসোস, পড়স, চলে যাস। আমার তো নিস্তার নাই রে! ব্যাচের পর ব্যাচ আসতেই থাকে। এই যে তোর আন্টিরা, ছুটির দিনেও পায় না আমাকে। এই ভোঁতা হাট্টল-হাট্টলীর দলরে না দেখলে মন টিকে না আমার। দেখি, সময় করে একদিন যাব তোর ক্যাম্পাসে।’
শেষবেলায় ফিরে তাকালাম। স্যার সিগারেট ফেলে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন তাঁর প্রাণপ্রিয় ভুবনে, তাঁর নিজস্ব জগতে, গণিতের সম্মোহনী জগতে তাঁর প্রিয় হাট্টল-হাট্টলীর কাছে।
ধন্যবাদ কাজল স্যার। অসম্ভব সুন্দর কিছু স্মৃতির জন্য। জ্ঞানে–প্রজ্ঞায় বিকশিত করে হাজার হাজার আলোকিত মানুষ গড়ে তুললেন যে কারিগর, মৃত্যুর সাধ্য কি তাঁকে বিলীন করে মরণ সাগরের তীরে...। আপনি আছেন, থাকবেন চির অমর হয়ে।
২০১৯ সালের ৪ নভেম্বর সকালে চট্টগ্রামে ডিসি হিলে সকালের ব্যায়ামরত অবস্থায় অকালে মৃত্যুবরণ করেন কাজল স্যার। মহান এই শিক্ষকের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
শিক্ষার্থী, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়