ভাইয়ার সাইকেল

গল্পটি ২০২৪ সালের জুনে প্রকাশিত বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের ‘তারুণ্য’ ম্যাগাজিনের দশম সংখ্যা থেকে নেওয়া।

অলংকরণ: অভিনয় আহমেদ

যখন সাইকেল চালানো শিখেছি, তখন আমার সময় লেগেছে মাত্র এক ঘণ্টা। শুরুর দিকে এমদাদুল ভাই বলেছে সাইকেল চলাতে হলে তোকে প্রথমে পড়ে হাত–পা ছিলতে হবে। ভালো হয় যদি একটু সাইকেল–ধোয়া পানি খেতে পারিস। আমি ভাইয়ার কথায় হো হো করে হেসে দিলাম। এরপর শিখিয়ে দিল কীভাবে সাইকেল চালাতে হয়। দুই হাত দিয়ে শক্ত করে ধরে সামনের দিকে তাকিয়ে জোরে জোরে প্যাডেল চাপতে হয়। এরপর আমাকে একটা ঢালু জায়গা থেকে সাইকেলসহ ঠেলে দিল, আমিও নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলাম।

পরে অবশ্য আস্তে আস্তে শিখে গেছি। যখন সাইকেল চালানো পুরো আয়ত্তে এসেছে, তখন থেকেই সাইকেল নিয়ে যেতাম দূরদূরান্তে। গ্রামের আঁকাবাঁকা কাঁচা রাস্তায় প্যাডেলে চাপ দিয়ে সব জড়তা ঠেলে আসার অনুভূতি ছিল অন্য রকমের। মাঝেমধ্যে সাইকেল পাশে রেখে সবুজ নরম ঘাসে গা এলিয়ে দিতাম।

বাবা মারা যাওয়ার পর সংসারের হাল ধরতে ভাইয়া দিন–রাত এক করে পরিশ্রম করছে। গাঁয়ে তেমন ভালো কাজ নেই। যখন যা পায় তাই করে। কখনো ইট-সিমেন্টবোঝাই গাড়ি টানা কিংবা কখনো পিলার বানানো মিস্ত্রি হিসেবে কাজ করা।

সেদিন ছিল ১৭ তারিখ, বৈশাখের কঠিন রোদ। কীভাবে ছেড়ে যাব স্মৃতিমাখা এই গ্রাম। অবশ্য যাওয়া না–যাওয়া এখনো নিশ্চিত না। শহরের একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ হলেও ভর্তি হতে পারব কি না সন্দিহান। এরই মধ্যে একটা ব্যবস্থা হলো। ভাইয়া তার সাইকেলটা বিক্রি করে পঁয়ত্রিশ শ টাকা, সঙ্গে আরও কিছু টাকা আমার হাতে দিয়ে বলল, শহরে গিয়ে মন দিয়ে পড়াশোনা কর। টাকাপয়সা নিয়ে তোর চিন্তা করতে হবে না, আমি তো আছি।

যে ভাইয়া কিছুদিন আগেও সংসারের হাল টানতে টানতে ক্লান্ত হয়ে জিদে আমার একটি বই ছিঁড়ে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বলল, যা, কাজ করে খা; আজ সে ভাইয়া তার শখের সাইকেল বিক্রি করে টাকা তুলে দিল আমার হাতে। গাড়িতে ওঠার সময়ে ভাইয়াকে যখন বললাম, আসি ভাইয়া। তিনি কোনো উত্তর দিলেন না। অনেক ভিড়ের মধ্যে সেদিন দেখলাম ভাইয়াকে শার্টের হাতায় চোখ মুছতে।

লালবাগ, ঢাকা-১২১১