কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যের বিষয়বস্তু ও কাব্যশৈলী

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামছবি: সংগৃহীত

কবি কাজী নজরুল ইসলাম বাংলার বিদ্রোহী কবি নামে পরিচিত। ১৮৯৯ সালে বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন সাহিত্যের একজন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব ও বাঙালি আধুনিকতার পথিকৃৎ।

নজরুলের প্রাথমিক জীবন কষ্ট ও সংগ্রামের ছিল। অল্প বয়সে পিতাকে হারিয়েছেন। নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হওয়া সত্ত্বেও নজরুল ছোটবেলা থেকেই লেখালেখি ও সংগীতে অসাধারণ প্রতিভা প্রদর্শন করেছিলেন। তাঁর কাব্যিক প্রতিভা দ্রুততম সময়ের মধ্যে কলকাতার সাহিত্যিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত কবিতা ‘বিদ্রোহী’। এ কবিতায় তিনি চেতনা ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের মূর্ত প্রতীক। এটি স্বৈরাচারের উৎখাত ও ন্যায়সংগত সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রতীক। এ ছাড়া সাম্যবাদী কবিতা ও অসংখ্য কালজয়ী গান রচনা করেছেন।

শতবর্ষ আগে ১৯২২ সালে বাংলা কবিতা ও গানের চলমান ধারায় প্রবল প্রকম্প সৃষ্টি করে জ্বলে উঠেছিল অগ্নিগিরির জ্বালামুখ, যার নাম ‘অগ্নিবীণা’। এটি কাজী নজরুল ইসলামের প্রথম প্রকাশিত কাব্য, যা বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সেরা অবদান।

যখন কবি বলতে সবাই রবীন্দ্রনাথকেই বুঝত, তখন রবীন্দ্রবলয়ের বাইরে এসে সম্পূর্ণ ভিন্নধারার কবিতা নিয়ে হাজির হয়েছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। ‘অগ্নিবীণা’ কাব্যগ্রন্থের প্রতিটি কবিতায় অনুপ্রাস, উপমা, রূপক ও ছন্দ প্রয়োগে অসামান্য প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন তিনি। ‘প্রলয়োল্লাস’ কবিতায় কবির উচ্চারণ—
‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর!
তোরা সব জয়ধ্বনি কর!!
ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কালবোশেখীর ঝড়।
তোরা সব জয়ধ্বনি কর!
তোরা সব জয়ধ্বনি কর!!’

কবি যেমন ছিলেন চির নতুন ও চঞ্চল, তেমনি নতুনদের আহ্বান জানিয়েছেন নবছন্দে—
‘ঐ ভাঙা-গড়া খেলা যে তার কিসের তবে ডর?
তোরা সব জয়ধ্বনি কর!
বধূরা প্রদীপ তুলে ধর।
কাল ভয়ঙ্করের বেশে এবার ঐ আসে সুন্দর!
তোরা সব জয়ধ্বনি কর!
তোরা সব জয়ধ্বনি কর!!’
কবিতাটিতে কবি নতুনের জয়গানে মুখর হয়েছেন। কবি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন, নতুনেরাই পারে নব কিছু সৃষ্টি করতে। নজরুল তাঁর বিখ্যাত ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় বলেছেন—
‘বল বীর
বল উন্নত মম শির!
শির নেহারি’ আমারি নত শির ওই শিখর হিমাদ্রির!
বল বীর
বল মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি’
চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি’
ভূলোক দ্যুলোক গোলোক ভেদিয়া
খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া,
উঠিয়াছি চির–বিস্ময় আমি বিশ্ব–বিধাতৃর!’

এ কবিতায় আবেগের সঙ্গে অন্যায় ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে অবাধ্যতা ঘোষণা করে নিজেকে একজন নির্ভীক যোদ্ধা হিসেবে চিত্রিত করেছেন নজরুল। নিপীড়িত ব্যক্তিদের অধিকারের জন্য সংগ্রাম করে গেছেন তিনি। কবিতাটির শক্তিশালী চিত্রকল্প ও আলোড়ন সৃষ্টিকারী বক্তৃতা বিদ্রোহের চেতনাকে ধারণ করেছে, যা নজরুলের সাহিত্যিক রচনাকে সংজ্ঞায়িত করে এবং পরবর্তী প্রজন্মকে অত্যাচার প্রতিরোধ করতে ও ন্যায়ের জন্য লড়াই করতে অনুপ্রাণিত করে। ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় কবি অন্যায়-অনিয়মের বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে কীভাবে জ্বলে উঠতে হয়, তাই বলেছেন পঙ্‌ক্তিগুলোয়।

অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বলেন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, রাশিয়ার বলশেভিক বিপ্লব, ভারতে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন ও অসহযোগ আন্দোলন, তুরস্কে কামাল পাশার আবির্ভাব—বাংলা সাহিত্যের এসব পটভূমি নজরুলকে বিদ্রোহীর মতো কবিতা লেখার জন্য প্রভাবিত করেছে।

নজরুল তাঁর কবিতাকে একটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন। অত্যাচারী শক্তিকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য যারা প্রান্তিক ও দরিদ্র মানুষের কণ্ঠকে স্তব্ধ করতে চেয়েছিল। তাঁর শক্তিশালী চরণগুলো অত্যাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে তীব্র বিরোধিতা প্রকাশ করে পাঠকদের অধিকারের জন্য জেগে ওঠার আহ্বান জানায়।

‘ধূমকেতু’ কাজী নজরুল ইসলাম সম্পাদিত অর্ধ-সাপ্তাহিক পত্রিকা। বিপ্লবীদের মুখপত্র এ পত্রিকাটি ১৩২৯ বঙ্গাব্দের ২৬ শ্রাবণ (১১ আগস্ট ১৯২২) আত্মপ্রকাশ করে। প্রথম সংখ্যায় নজরুলের অনলবর্ষী দীর্ঘ কবিতা ‘ধূমকেতু’ প্রকাশিত হয়। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়সহ অনেক দেশবরেণ্য ব্যক্তি ও ‘অমৃতবাজার’ পত্রিকা ধূমকেতুর আবির্ভাবকে উষ্ণ অভিনন্দন জানায়। শরৎচন্দ্রের কিছু নিবন্ধও এতে প্রকাশিত হয়। বিপ্লব, কৃষক-মজদুর ও মধ্যবিত্তের জাগৃতি ছিল এর মূল লক্ষ্য। তাঁর অগ্নিঝরা ভাষা ও নির্ভীক বক্তব্যের জন্য পত্রিকাটি দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ‘ধূমকেতু’তে নজরুল ইসলাম মানুষের স্বাধীনতা, সাম্য ও মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে ভাস্বর করে দুরন্ত আবেগে সম্পাদকীয় নিবন্ধ, বিবৃতি ও কবিতা লিখেছিলেন। ‘ধূমকেতু’তে প্রকাশিত নজরুলের গদ্য রচনাগুলো পরে ‘দুর্দিনের যাত্রী’ ও ‘রুদ্রমঙ্গল’ গ্রন্থে এবং কবিতাগুলো ‘বিষের বাঁশী’ ও ‘ভাঙার গান’ কাব্যগ্রন্থে সংকলিত হয়।

বাঙালি সাহিত্যিকদের মধ্যে কাজী নজরুল ইসলাম প্রথম কবি, যিনি সাম্যবাদী চেতনায় অনুপ্রাণিত হয়ে সাহিত্য রচনা করেন। মানবতার মহৎ আদর্শে উদ্বুদ্ধ কবি নজরুলের কাব্য-সাধনার এক প্রধান অংশজুড়ে আছে হিন্দু-মুসলমানের সম্প্রীতি কামনা। নজরুল মানসে হিন্দু-মুসলমান বৈপরীত্যের দ্যোতনা না হয়ে পরিপূরক হয়েছে তাঁর অসামান্য সাম্যবাদী চেতনার ফলে। হিন্দু-মুসলমানই শুধু নয়, মহামানবের মিলনকামী কবি উদাত্ত কণ্ঠে গেয়েছেন—
‘যেখানে আসিয়া এক হ’য়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান,
যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-ক্রীশ্চান।’

দুঃখের বিষয় এই যে খেলাফত আন্দোলন ও অসহযোগ আন্দোলনকেন্দ্রিক হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। অল্প সময়ের মধ্যেই এ সম্প্রীতিতে ভাঙন ধরে এবং দাঙ্গা-হাঙ্গামা শুরু হয়। এই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় নজরুল ইসলাম অত্যন্ত মর্মাহত হন। দাঙ্গা নিয়ে সাপ্তাহিক ‘গণবাণী’তে ‘মন্দির ও মসজিদ’ ও ‘হিন্দু-মুসলমান’ নামে দুটি প্রবন্ধ লেখেন। দাঙ্গা–বিক্ষুব্ধ পরিবেশেই ১৯২৬ সালে কংগ্রেসের বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলনের উদ্বোধনী সংগীত হিসেবে লেখেন ‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার’। এখানে কবি তরুণকে তাঁর অমিত যৌবনশক্তি মহাবিদ্রোহীর মতো কাজে লাগাতে আহ্বান করেছেন—
‘অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানে না সন্তরণ
কাণ্ডারী! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তি–পণ!
‘হিন্দু না ওরা মুসলিম?’ ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?
কাণ্ডারী! বল, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র!’

কাজী নজরুল ইসলাম দেশের তরুণসমাজকে সব দ্বন্দ্বের ঊর্ধ্বে থেকে মানবতার উচ্চাদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে দেশের সেবায়, মানবকল্যাণে উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন।
কবি কাজী নজরুল ইসলাম সাহিত্য ও সংগীতে অবদান রাখার পাশাপাশি নারী ও পুরুষের সমতা এবং নারী অধিকারের জন্য একজন কট্টর সমর্থক ছিলেন।
‘সাম্যের গান গাই—
আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই!
বিশ্বে যা–কিছু মহান সৃষ্টি চির–কল্যাণকর,
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।
অথবা:
পুরুষ এনেছে দিবসের জ্বালাতপ্ত রৌদ্রদাহ
কামিনী এনেছে যামিনী–শান্তি, সমীরণ, বারিবাহ!’

দেশপ্রেম ছিল নজরুলের রচনায় আরেকটি পুনরাবৃত্ত থিম। তিনি আন্তরিকভাবে নিজের দেশ ও এর স্বাধীনতার জন্য লড়াইয়ের গুরুত্বে বিশ্বাস করতেন। মাতৃভূমির প্রতি আবেগপ্রবণ ভালোবাসা তাঁর কবিতা, ছড়া ও গানে স্পষ্ট ছিল; যা জাতীয়তাবাদের চেতনা উদ্‌যাপন করে এবং জনগণকে তাদের স্বাধীনতাসংগ্রামে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানায়।

বাঙালির সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক চেতনার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে কাজী নজরুল ইসলামের গান। তিনি একজন প্রতিভাধর সংগীতশিল্পী ছিলেন। তাঁর গান ‘নজরুল সংগীত’ নামে পরিচিত।
নজরুলের সাহিত্যের ভান্ডার শুধু কবিতা ও গানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এ ছাড়া তিনি একজন বিশিষ্ট নাট্যকার ছিলেন। তাঁর প্রথম প্রকাশিত নাটক—‘ঝিলিমিলি’ (নাট্যগ্রন্থ) ১৯৩০, ‘আলেয়া’ (গীতিনাট্য) ১৯৩১।

কবি কাজী নজরুল ছিলেন ক্ষণজন্মা মহান এক পুরুষ। তাঁর কর্ম ও জীবন বাংলা ও বাঙালির চিন্তা ও চেতনাকে আজও দারুণভাবে নাড়া দেয়। নজরুল ছিলেন এমন এক মহৎ প্রাণ, যিনি বাঙালির অফুরন্ত আবেগ, বাঁধনহারা উচ্ছ্বাস আর প্রবল প্রাণশক্তিকে আপন আত্মায় ধারণ করে সারা জীবন দ্রোহ, প্রেম, সাম্য ও মানবতার বাণী শুনিয়েছেন। অনাচার ও অত্যাচার প্রতিরোধে উৎপীড়িতের চিরদিনের প্রেরণা তিনি।

তারাগঞ্জ, রংপুর