এই ছোট্ট জীবনে সবচেয়ে বেশি আনন্দিত হই পূর্ণতায় এবং বেশি ব্যথা পাই বিচ্ছেদে। আমার ক্ষেত্রেও, আশপাশের মানুষের ক্ষেত্রেও।
রাস্তার পাশে নার্সারি দেখলেই দাঁড়াই কিছুক্ষণ। ফুলের সঙ্গে কথা বলি। আজকেও দাঁড়ালাম। বসন্তের বাসন্তী হয়ে ফুটে থাকা একটি ফুলকে একবার জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি আসলে কিসের প্রতীক?’ ফুলটি উত্তর দিল, ‘আমি তোমারই প্রতীক।’
আমি আশ্চর্য হলাম। নিজে নিজে ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর চেষ্টা করলাম। পারলাম না বলে আবার ফুলটির কাছে এগিয়ে গেলাম। বললাম, ‘আমার প্রতীক কীভাবে, একটু বুঝিয়ে বলবে?’
ফুলটির গায়ে তখন স্নিগ্ধ হাওয়া এসে পড়ায় একটু হেলে গেল। কী অপরূপ সেই দৃশ্য! ফুলটি জবাব দিল, ‘আরেকটুখানি পথ এগোলেই যে ফুলের দেখা পাবে বলে এই পথে যাচ্ছ, তাতেই তোমার মনের সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে। গাছে থাকা ফুল আর জীবনের ফুলের মধ্যে পার্থক্য আছে।’ আমি হো হো করে হেসে উঠলাম। নার্সারির দোকানদার জিজ্ঞেস করলেন, ‘মামা হাসছেন কেন?’
বললাম, ‘এমনিই।’ হাসি থামিয়ে ফুলটিকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘যাবে সঙ্গে আমার জীবনের ফুটন্ত ফুলের কাছে?’ ফুলটি কিছু বলল না। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, ‘যাবে?’
ফুলটি বলল, ‘নিয়ে চলো।’ আমি নিয়ে গেলাম।
বাড়িতে ফিরে এসে ফুলটিকে যত্ন করে একটু পানিতে ডুবিয়ে রাখলাম। বইগুলোর পাশে ফুলটিকে দারুণ মানিয়েছে। আমি তাকিয়ে আছি ফুলের দিকে। ফুলটি জিজ্ঞেস করল, ‘মায়া লাগছে?’
আমি বললাম, ‘হ্যাঁ।’
ফুলটি আমাকে আরেকবার আশ্চর্য করে দিয়ে বলল, ‘আমার জন্য তোমার কোনো মায়া নেই। তোমার সমস্ত মায়া তোমার জীবনের ফুটন্ত ফুলের প্রতি। আমাকে তার হাতে পৌঁছাতে না পারার অভিমানে তুমি আমার দিকে তাকিয়ে আছ। ভাবছ, কবে আমাকে তার কাছে পৌঁছাবে। এই ভেবে তোমার মায়া হচ্ছে!’
আমি কিছু বললাম না। ফুলের কথার কাছে হেরে গেলাম একপ্রকার। ঘরের বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম। অন্ধকার ঘরের জানালা দিয়ে দেখলাম নিভু নিভু চাঁদের আলো। ধ্রুবতারার দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললাম, জীবনে ফুটন্ত ফুলের মনে অনেক অভিমান জমেছে। অভিমান মুছে গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে।
মনে মনে বলা কথা ফুলটি কীভাবে জানতে পারল জানি না। সে একটু মুচকি হেসে বলল, ‘তোমার বিশ্বাসের শক্তি আছে। যিনি দেওয়া কিংবা নেওয়ার মালিক—তার কাছেই যাও।’
আমি এপাশ ঘুরে বললাম, ‘আচ্ছা।’
মনে হলো ওষুধের তীব্রতা কাজ করতে শুরু করেছে। দুচোখের পাতা বুজে এল। চোখের পাপড়ির ভার সহ্য করতে না পেরে চোখ বুজলাম। দেখলাম অসংখ্য ফুল ফুটে আছে মাঠজুড়ে। কী সুন্দর সেই দৃশ্য! সহস্র ফুলের মধ্যে একজন নারী দাঁড়িয়ে আছে। তীব্রভাবে ভাঁজ পড়ে যাওয়া চোখ মেলে তাকিয়ে দেখি, নিমপাতা।
মুহূর্তেই সমস্ত ফুলগুলোকে নীরস মনে হলো। মুচকি হাসিতে জীবনে ফুটন্ত ফুলটিকে মনে হলো, আমার জীবনের সমস্ত মায়া মিশিয়ে ফুলটি হাসছে। বলছে, কী দেখছেন অমন করে?
আমি বললাম, তোমাকে।
আগারগাঁও, ঢাকা-১২০৭